বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেশী স্মৃতিচারণ স্থান হিসেবে পরিচিত এই নারায়ণগঞ্জ। যে জেলায় বঙ্গবন্ধুর পদচারন ঘটেছিল বহুবার। ৬৯ এর গন অভ্যুথান, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ও ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ সকল আন্দোলনের ভূমিকার কেন্দ্রবিন্দু এই নারায়ণগঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের সেই জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে ঘরে বসে থাকতে পারেননি এই জেলার বীর সন্তানরা। মহান নেতার ডাকে সারা দিয়ে দেশের মাটি ও মানুষকে শত্রুমুক্ত করতে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাই। তাদের আত্মত্যাগের দাম আমরা কখনো দিতে পারবো না। ইতিহাসের পাতায় পাতায় থাকবে তাদের আত্মত্যাগ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজও তাদের সম্মান হুমকির মুখে। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর সিটি কবরস্থান যেখানে ঘুমিয়ে আছে জাতির অনেক বীর সন্তানরা। রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ভাষা সৈনিক ও বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। সম্প্রীতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার মিজানের শ্বশানের পুকুর খনন কাজ করায় কবরের মাটিগুলো সরে নিচের দিকে ঢেবে গেছে। শ্বশানের মাটি ফেলা হয়েছে বীরমুক্তিযোদ্ধা সহ সকল কবরে। যার কারনে কবস্থানের সংরক্ষিত বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কবর এখন জরাজীর্ন। অনেক কবরের নাম ফলকগুলোও এখন নেই। এই কবরগুলো সংস্কার না এবং যাদের জন্য কবরগুলো এই অবস্থা হয়েছে তাদের বিচার না করে উল্টো অন্যের উপর দোষারোপ করে নিজের দায় এড়াতে চায় মেয়র আইভী।
এদিকে কবরস্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ভাষা সৈনিক ও বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবরে শ্মশানের মাটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা।
এ ঘটনাকে ‘ধামাচাপা’ দিতে সিটি করপোরেশনের প্যাডে মেয়র ‘মিথ্যাচার’ করেছেন বলে অভিযোগ তাদের।
তারা বলেন, প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানের স্ত্রী পারভীন ওসমানের নির্দেশে তাদের নিকটাত্মীয় জনৈক নাসির বাইরে থেকে মাটি এনে কবরে দিয়েছে বলে মেয়রের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। পরদিন পারভীন ওসমান সাংবাদিকদের জানান, পুরো বিষয়টি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর মিথ্যাচার। নাসির নামে আমাদের কোনো আত্মীয় নেই। তিনি কাউকে মাটি দেওয়ার নির্দেশও দেননি।
এ ব্যাপারে পারভীন ওসমান জানান, ‘আমার স্বামী (নাসিম ওসমান) মারা গেছেন সাত বছর। শ্বশুর (সাবেক এমপি স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত একেএম সামছুজ্জোহা) মারা গেছেন অনেক বছর। এত দিন কবরে পানি উঠল না, আর এখন পানি ওঠে বলে শ্মশানের মাটি দিয়ে কবর ঢেকে দেওয়া হলো। আবার মিথ্যাচার করা হলো আমি নাকি নির্দেশ দিয়েছি’।
তিনি বলেন, লাল মাটি, ‘সাদা মাটি বলে নারায়ণগঞ্জবাসীকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হলো। আমি আইভীকে (সিটি মেয়র) বলব আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, কবরবাসীদের স্বজনদের কাছে ক্ষমা চান, নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে ক্ষমা চান। পুরো বিষয়টি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো’।
নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলছেন, মৃত্যুর পরও প্রাপ্ত সম্মানটুকুও যদি আমরা না পাই! মাসদাইর কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কবরে শ্মশানের মাটি দেওয়া, পাইকপাড়া কবরস্থানে বীর মুক্তিযোদ্ধা পুতুলের কবর ভেঙে সেখানে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধাকে কবরস্থ করা এবং কয়েক মাস আগেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক কমিশনার আফতাব উদ্দিন আহমেদের কবর ভেঙে সেখানে মেয়র আইভীর ভাইয়ের স্ত্রীকে কবর দেওয়ার মতো ঘটনা হতাশাজনক।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন পুতুলের ছেলে শেখ মিজানুর রহমান সজীব বলেন, পাইকপাড়ায় আমার বাবার কবরের নামফলক সরিয়ে কবর নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। আর এবার মাসদাইর কবরস্থানেও ১৫/২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর শ্মশানের মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলাটা, সবই যেন এক সূত্রে গাঁথা। এগুলো হীন চক্রান্ত। দেশে বীর সন্তানদের অপমানের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। আমাদের কান্না থামানো কষ্টকর। এমন কর্মকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না। যেহেতু নগরীর কবরস্থান গুলো সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে, তাই দায় ভার তাদেরই উপর বর্তায় । আমরা অবিলম্বে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য সাবেক কমান্ডার ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কবরস্থানের সীমানা দেয়ালটা ভেঙে গেছে। কবরস্থানে শ্মশানের মাটি ইস্যুতে কবরস্থান কর্তৃপক্ষের সতর্ক থাকা উচিত। এখানে ভালো মাটি দিতে হবে। নতুন মাটি যে পর্যন্ত না দেবে, সে পর্যন্ত হবে না। ওখানে তো জাতির বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কবর, যাদের রাষ্ট্র সম্মানিত করে। তাদের প্রতি আরো সতর্ক থাকা উচিত। তাদের কবর কোনোভাবে যাতে অবমাননা না করা হয়, সেদিকেও সবার খেয়াল রাখা উচিত বলে আমি মনে করি’।
এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ রশীদ বলেন, সিটি করপোরেশনের টেন্ডারে শ্মশানের উন্নয়নকাজ চলছিল। পুকুরের পানি সরিয়ে ঘাটলা করার জন্য মাটি তোলা হয়েছে। সেই মাটি কবরস্থানে কেন রাখা হলো? কে রাখল? কেন এগুলো তদারকি করা হলো না। স্পর্শকাতর বিষয়, মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা সৈনিকদের কবর অবমাননার দায় কিছুতেই সিটি করপোরেশন এড়াতে পারে না। এ ঘটনায় ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মেয়র আইভী যে মিথ্যাচার করেছেন তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল আমিন বলেন, আমরা করোনার টিকা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। এ ব্যাপারে মেয়র মহোদয় লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।