গৌতম রায়,বিজয় বার্তা ২৪ ডেস্ক
আজ থেকে প্রায় ২৬ বছর আগে বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় থাকাবস্থাতেই ১৯৯১ সালের শেষের দিকে ইন্ডিয়া হয়ে থাইল্যান্ড আসি ঘুরতে। তারপর ট্যাক্সিতে করে মালয়েশিয়া। তখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রায় একদম অপরিচিত দেশ মালয়েশিয়া। ভাবলে অবাক হবেন যে মালয়েশিয়া পর্যন্ত পৌছাতে আমার খরচ হয়েছিল মাত্র ৭ হাজার টাকা। এত কম টাকায় এদেশে আসা আমার জনামতে আজ পর্যন্ত কেউ আসেনি। সেটা একটা রেকর্ড। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্যেই সেলায়াং একটি কোম্পানীতে (আজ যেখানে NSK সুপার মার্কেট রয়েছে) শ্রমিক সেজে গেলাম। মালিককে বললাম চাকুরী করব। উদ্দেশ্য খোঁজ খবর নেয়া। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে মালিক অবাক হলেন যে, এতদূর থেকে কাজ করতে এসেছি। মালিক একটি ইংরেজী পত্রিকা পড়তে দিলেন। তিনি থ হয়ে গেলেন। যখন ভাবলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলে পড়েছে সে এদেশে চাকুরী করবে শুনে। সাধারন কাজ দিতে যেন তার বিবেকে বাঁধছিল। কিন্তু আমি ভাবছি- তোমার দেশে কি চাকুরী করতে এসেছি? আমার উদ্দেশ্য তো জানার। কিন্তু কম বেতনে তিনি চাকুরী দিবেন না। আমাকেও ছাড়বেন না। কিছুদিনের জন্য স্বাধীন একটি কাজ দিলেন। তারপর তার অফিসের ষ্টাফ করে নিলেন। বেতন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা ছিল। তখন বাংলাদেশে ৩ হাজার টাকার চাকুরী মেলাও ছিল কষ্টের। সম্ভবত: এটাও রেকর্ড যে ঐ আমলে আমি প্রথম অফিসে চাকুরী করি। বাংলাদেশী শুনে মানুষ জড়ো হয়ে দেখতে আসতো। সন্মান করতো। মেয়েরা প্রেম করতে চাইতো। কিন্তু আবার অনেকের ধারনা ছিল- বাংলাদেশ ইথয়োপিয়ার মতো একটি গরীব দেশ। তারা বেশী চিনত এরশাদকেই। ১৯৮৮ এর বন্যার খবরাখবর শুনে বাংলাদেশকে মনে করতো দুর্গত এলাকা। অবশ্য মালয়েশিয়াও তখন সবে মাত্র জেগে উঠতে শুরু করেছে। বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতেই থাইল্যান্ড দিয়ে স্রোতের মতো আসতে শুরু করলো বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানী। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে মালয়েশিয়ার উপর রিপোর্ট করতে থাকলাম। মানুষকে ৪০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া আনতে দেখে বিবেকের তাড়নায় শুরু করলাম দালালের বিরুদ্ধে লেখা। সেই যে শুরু তা আজো চলছে। একসময় বন্ধ হয়ে গেল থাইল্যান্ডসহ সকল পোর্ট ভিসা। ভেবেছিলাম ভিসা থাকতে থাকতেই কয়েক মাস কাজ করে যা পাব তা দিয়ে কেনা কাটা করে দেশে চলে যাব। কিন্তু জানতাম না যে, আমার ভাগ্য মালয়েশিয়া আমাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে। ১৯৯১ সালে প্রথম অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ করার ঘোষনায় চালু হয় পাস খাস (Pass Khas). ভিসা থাকাবস্থাতেই পারমিট নিলাম। ১৯৯২ সালে এদেশে বিয়ে করি। ১৯৯৩ সালে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। সে বছরই প্রথম মালয়েশিয়ার কলিং ভিসা শুরু হয়। ভূয়া কোম্পানীতে শ্রমিক পাঠানোর অনুমোদন দিতে থাকে হাইকমিশন। তখন থেকেই দুর্নীতি হাইকমিশনের ঘাড়ে চেপে বসে। ৬০ হাজার টাকায় শ্রমিক এসে চাকুরি না পেয়ে পথে ঘাটে রাত কাটায়। আমি গর্জে উঠে প্রতিবাদ করতে লাগলাম কলমে। আমার নিউজে তোলপাড় পরে গেল দেশে। লেবার কাউন্সিলার ইসমাইল জবিউউল্লাহকে সরকার শো কোজ করে। সে সময় যে প্রতারিত অসহায় শ্রমিকদের পক্ষে আন্দোলন করেছিলাম আজ এরা অনেকেই মালয়েশিয়ায় প্রথম শ্রেনীর দালাল। ১৯৯৪ সালে পরিচয় হয় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক দরদী নেতা গোলাম আহাদের সাথে। ১৯৭৭ সালে তিনি মালয়েশিয়ার সাবাহ প্রদেশে আসেন ও পরে গভর্নরের মেয়েকে বিয়ে করেন। পশ্চিম মালয়েশিয়ায় এসে তিনি শুরু করেন শ্রমিকের অধিকার রক্ষার আন্দোলন। গত কয়েক বছর আগে এই শ্রমিক দরদী মানুষটি ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনিই ছিলেন শ্রমিকের স্বার্থে কাজ করার আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। তার মৃত্যুর পরই আমি একা হয়ে পড়ি। নিজেকে গুটিয়ে ফেলি ছোট্ট গন্ডীতে। আমি বাংলাদেশের পত্রিকায় লিখে আর তিনি এদেশের প্রশাসনের মাধ্যমে শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে দিনরাত কাজ করতে লাগলাম। ১৯৯৬ সালে কুয়ালালামপুর কিলাত কেলাব মাঠে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে। ঐ সময় বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার ছিল বাংলাদেশীরা। পুলিশের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করে প্রথম খেলার মাঠ থেকে গ্রেফতার হই। একই বছর জহুর বারুতে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে জহুর বারুতে বাঙ্গালী নিধন শুরু হয়। গোলাম আহাদ, আমি, হাইকমিশন কর্মকর্তা একযোগে চেষ্টা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করি। কিন্তু ১৯৯৬ সালেই বিবাহিত বাংলাদেশীদের এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার ঘোষনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেঘাদ জুনিত। বিক্ষোভে ফেটে পড়ি আমি। টিভি ৩ সহ এদেশের বিভিন্ন পত্রিকা মিডিয়ায় প্রতিবাদ করে বলি- আমি একা চলে যাব। কাউকে নিব না। এর দায় দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। তখন আমি ৪ সন্তানের জনক। সে সময় এ আন্দোলনে ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা জামিল হুসেইন নাসির, বর্তমান মালয়েশিয়া বিএনপি সভাপতি বাদেলুর রহমান খান ও আরো অনেকে। এরপর প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথীর মোহাম্মদ আমাদের দাবী মেনে নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সে সুবাদেই আজ অনেকে এদেশে বিয়ে করে ব্যবসা বানিজ্য করছেন, স্থায়ী হয়েছেন। কিন্তু কে জানেন সে ইতিহাস? ( দেখুন আগামীকাল)