রফিউর রাব্বি,বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
২০০৯ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা মানজারে হাসান হেনা দাসকে নিয়ে ‘অভিযাত্রী’ নামে ৯৬ মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেন। প্রামাণ্য চিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করব, আমৃত্যু কাজ করে যাব- জনসভার এ ধরনের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। বাস্তবে তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। চিন্তায়, মননে, কর্মে হেনা দাস গণমানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবন। তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন এদেশের লাখ লাখ মানুষ।’ সেবছরেই ২০ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হেনা দাস শৈশবেই প্রত্যক্ষ করলেন সাধারণ মানুষের উপর ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচার। সমাজের প্রচলিত অনিয়ম, অন্যায় তাঁকে শৈশবেই বিদ্রোহী করে তুলেছিল। অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন সময়ে গার্লস গাইডে যোগ দিতে যান তিনি। গার্লস গাইডের প্রথা অনুযায়ী তিনটি শপথ বাক্য উচ্চারণ করতে হতো সদস্যদের। এর একটি হল Shall be loyal to the king- শপথের এ মূঢ় আনুগত্য উচ্চারণ বিক্ষুদ্ধ করলো হেনা দাসকে। প্রতিবাদ করে তিনি সেখান থেকে চলে এলেন। নবম ও দশম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হলেন। ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুরমা ভ্যালি গার্লস স্টুডেন্টস কমিটি গঠনের কাজে যুক্ত হন। ১৯৪২ এর শুরুতেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং সার্বক্ষণিক কর্মী হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারাবিশ্বেই অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হয় ভারতে; মন্বন্তর নেমে আসে। মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তখন একদিকে ফ্যাসিস্ট শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধ অপরদিকে আত্মরক্ষা, মানুষ রক্ষার প্রশ্ন। মানুষকে বাঁচানোটাই তখন জরুরি হয়ে পড়লো। ’৪৩ এর মন্বন্তরে তিনি বুভুক্ষু মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তখন সারা বাংলায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে উঠলো। হেনা দাসের উদ্যোগে সিলেট জেলায় গড়ে উঠলো মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। তখন সংস্কৃতিতে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত করে গণনাট্য আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের মানচিত্র বদলায়। সে নতুন বাস্তবতায় এখানে সংস্কৃতিতে একটি জাগরণ তৈরি করে গণনাট্য আন্দোলন। হেনা দাস গণনাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে সে সংস্কৃতির আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে এমনি প্রাণোন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল যা বলা চলে তৎপরবর্তি কালে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল।
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের ধারাবাহিকতা হেনা দাসের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৬ সালে সিলেট জেলার ছাত্র আন্দোলনকে জোরদার করার দায়িত্ব পড়ে তাঁর উপর। যুক্ত হন ছাত্র ফ্রন্টে। ১৯৪৮ রোহিনী দাসের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। রোহিনী দাস ছিলেন সিলেট জেলা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা। ভূমি ব্যবস্থা ও কৃষক সমস্যা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ও উপলব্ধি, কৃষক সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার মতো দক্ষতা, সেবামূলক কাজে অসীম নৈপুণ্য, সাংবাদিকতা, ত্যাগে ও নিষ্ঠায় অসাধারণত্ব ছিল রোহিনী দাসের উলে¬খযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
১৯৪২ সালে সিলেট উইমেন্স কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির উপর নেমে আসে অত্যাচার আর তিনি আত্মগোপন অবস্থায় গ্রামে চলে যান। তখন গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক কৃষক আন্দোলন, প্রজাসত্ব আইন সংশোধনের আন্দোলন, খাজনা বন্ধ আন্দোলন, গাছকাটার অধিকারসহ কৃষকদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ওইসব আন্দোলনের ঐতিহ্য ও শক্তি থেকে গড়ে উঠেছিল নানকার আন্দোলন। নানকার মেয়েদের সচেতন করে আন্দোলনে সংগঠিত করেন হেনা দাস। শহরতলিতে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সেল তৈরি হলে সেখানে চলে যান তিনি। সেখান থেকে চা বাগানের শ্রমিক বস্তিতে মেয়েদের সংগঠিত করার কাজে লেগে যান। চলি¬শের দশকের উতুঙ্গু সময়টিতে হেনা দাসের বাড়িটি সিলেট জেলার দ্বিতীয় পার্টি হাউস হিসেবে পরিচিত ছিল। তেভাগা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, টংক আন্দোলন, রেল শ্রমিক আন্দোলন, নৌ বিদ্রোহ, বিভিন্ন নারী আন্দোলন তখন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দশ বছর আত্মপোগন থাকার পর ১৯৫৮ সালে হেনা দাস গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড পাস করেন। ১৯৬১ সালে নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে যোগদান করেন। ১৯৮৯ সালে এই স্কুল থেকেই অবসর গ্রহণ করেন। মাঝখানে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত মহাখালী আদর্শ গার্লস স্কুলের সাথে যুক্ত ছিলেন।
১৯৫৮ সাল থেকেই হেনা দাস শিক্ষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ১২ বছর তিনি বেৃসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ও পরবর্তিতে সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির মুখপাত্র গণশিক্ষার তিনি সম্পাদক ছিলেন। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী ছিলেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : স্মৃতিময় দিনগুলো, স্মৃতিময় ’৭১, উজ্জ্বল স্মৃতি, আমার শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন, নারী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, চার পুরুষের কাহিনী, নির্বাচিত প্রবন্ধ। বর্ণাঢ্য জীবনে হেনা দাস বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তার মধ্যে রোকেয়া স্বর্ণপদক, অনন্য শীর্ষ দশ, আহম্মদ শরীফ পুরস্কার, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীয় সম্মননা, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট-এর সম্মাননা, স্টেপ টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট-এর রোকেয়া পদক, সিপিবি’র সুনামগঞ্জ জেলা সম্মাননা উলে¬খযোগ্য।
১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় হেনা দাসের জন্ম। বাবা সতীশ চন্দ্র দত্ত, মা মনোরমা দত্ত। গণমানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে নিবেদন করা সহজ ব্যাপার নয়। খুবই কঠিন একটা কাজ। হেনা দাস সেই কাজটাই করেছেন। মানুষের কল্যাণের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ত্যাগ, দীক্ষা ও মানবতাবোধ আমাদের প্রাণিত করে, অন্ধকারে পথ দেখায়। পথ হারিয়ে যাওয়া নবকুমারকে কপালকুণ্ডলা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ তাকে সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন। হেনা দাস পথ হারিয়ে ফেলা মানুষদের পথ দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন এ সমাজেরই কপালকুণ্ডলা। আমাদের বাতিঘর।

