বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
ব্যবসায়ী স্বপন সাহা গুমের নেপথ্যে ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ। প্রবীর হত্যাকান্ডের তদন্তে বের হয়ে আসছে এসব নানা চালঞ্চ্যকর তথ্য। ইতিমধ্যে মামুন ও রত্না নামে দুইজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এসময় আটককৃত রত্না চক্রবর্তীর কাছে থেকে স্বপন সাহার ২ টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয় বলে জানা যায়। নিতাইগঞ্জ এলাকার মৃত সোনাতন সাহার ছেলে স্বপন সাহা। তিনি প্রবীর ও পিন্টু একজন ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। জানা যায়, পিন্টুর পরকিয়া প্রেমের কথা জেনে ফেলায় গুম হতে হয় স্বপনকে। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে প্রবীর ঘোষের হত্যকান্ডের মতই স্বপনকে হত্যা করা হয়েছে।
খোজ নিয়ে জানা যায় স্বপন একটি গার্মেন্টসের মালিক ছিলেন। এই ব্যবসা লস হওয়ার পর থেকে সে পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিং এর কাজ করতেন। এর পাশাপাশি সে গার্মেন্টস স্টক লটের ব্যবসা করতেন। সারাদিন কর্ম শেষে প্রবীর ও পিন্টু সহ তার বন্ধুদের সাথে আমলাপাড়ায় একসাথে আড্ডা দিতেন। আমলাপাড়ায় স্বপন সাহাদের একটি পৈতিক বাড়ি আছে। সেই সুবাধে সেখানে তাদের সাথে তার পরিচয়।
এদিকে শনিবার নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল মেজিষ্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে পৌনে ৫ ঘন্টার জবানবন্দীতে পিন্টু তুলে ধরেন হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক ঘটনা। পিন্টু তার জবানবন্দীতে স্বীকার করেছেন বন্ধু প্রবীর ঘোষকে একাই হত্যা করেছে সে। আর বেড়িয়ে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য।
জবানবন্দীতে পিন্টু বলেন, বছর দেড়েক আগে আমলাড়ার মহসিন মোল্লার ছেলে মামুন মোল্লা(৫০)নামে এক বড় ভাই আমাকে আমার বন্ধুদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তারা আমার ভাল চায় না খারাপ চায়। আর তারা আমার বন্ধু নাকি শত্রু বলে। আমি তাদের বন্ধু পরিচয় দিলে তখন বড় ভাই আমাকে থাপ্পর মারে । আর বলে ওরা তর ক্ষতি চায়। এসময় সে প্রবীরকে ফোন দেয়। তখন প্রবীর আমাকে ফাসানোর কথা বলে। আমাকে ক্ষতি করার কথা বলে। বড় ভাই আবার অন্যান্য বন্ধুদের ফোন দেয় তারাও একই বলে। এসব কথা শোনে পিন্টুর রাগ জম্মে। বড় ভাইয়ের ভাষ্য মতে পিন্টুর ব্যবসা নস্ট করতে চায় তার বন্ধুরা। আর এই বড় ভাই তার কাছ থেকে ব্যবসা বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য কয়েক দফা টাকা নিয়েছিল। মূলত তখন থেকেই প্রবীর সহ সকল বন্ধুদের হত্যার পরিকল্পনা করে পিন্টু।
গত ১০ জুলাই প্রবীর ঘোষ হত্যায় রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে ঘাতক পিন্টু ডিবিকে জানিয়েছে, স্বপন বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর সাথে কলকাতায় স্বপনের দেখাও হয়েছিল।
পিন্টু জবানবন্দীর বিস্তারিত সম্পর্কে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো জানান, প্রবীরকে হত্যা করতে ঈদের ছুটি ও বিশ্বকাপ ফুটবলের নিরবতাকে কাজে লাগায় পিন্টু। গত ১৮ জুন রাত ১০টায় প্রবীরকে বিয়ার (মাদক) খাওয়ানোর কথা বলে আমলাপাড়াস্থ ঠান্ডু মিয়ার বাড়িতে নিয়ে আসে পিন্টু। এরপর বাসায় নিয়ে তাকে স্প্রাইট ও বিস্কুট খেতে দিয়ে টিভি চালু করে সে। এরই মাঝে পিন্টু রান্নাঘর থেকে চাপাতি নিয়ে পেছন থেকে প্রবীরের মাথায় আঘাত করে। এ ঘটনায় প্রবীর বিছানায় লুটিয়ে পড়লেও বাঁচার জন্য পিন্টুর বুকে লাথি মারে। তবে পিশাচ পিন্টু মূহুর্তে প্রবীরের মাথায় এলাপাথারী আরো ২/৩ বার আঘাত করলে নিস্তেজ হয়ে গোংরাতে থাকে সে। এরপর পিন্টু তার বুকে উপড় বসে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে প্রবীরকে হত্যা করে। পত্যার পর লাশ গুম করতে বাথরুমে নিয়ে ৭ খন্ড করা হয় প্রবীরের নিথর দেহ। তার মাথা, দুই হাত, দুই পা, বডি, পেটের অংশ ও পাজর খন্ড করে ৪টি সিমেন্টের ব্যাগের করে ভুট কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে তিনটি ব্যাগ বাসার নিচতলায় সেপটিক ট্যাংকে এবং অপর ব্যাগটি পাশের বাসার পঁচা নর্দমায় ফেলে দেয়। এরপর রক্তমাখা চাঁদর ও বালিশ অন্য একটি ব্যাগে ভরে শহরের চারারগোপ আলুর ঘাট নদীতে ফেলে দেয়। আর কিলিং মিশনে ব্যবহৃত চাপাতি এবং প্রবীরের সেন্ডেল ফেলা হয় বাসার পাশে ময়লার স্তূপে।
নিজেকে বাঁচাতে পিন্টুর কৌশল অবলম্বন করেন, হত্যাকান্ডের পর নিজেকে সন্দেহ থেকে দূরে রাখতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে থাকে ঘাতক পিন্টু। ঘটনা ধামাচাপা দিতে ঐ রাতেই প্রবীরের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সাথে নিয়ে প্রবীরকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে পিন্টু। খুনের ঘটনাটি অপহরণ নাটক সাজাতে পিন্টু তার সহযোগী বাপন ভৌমিককে প্রবীরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দিয়ে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে বাপন পিন্টুর শেখানো মতো প্রবীরের মোবাইল থেকে মুক্তিপনের দাবীতে এক কোটি টাকা চেয়ে প্রবীরের পরিবারের কাছে ম্যাসেজ পাঠায়। পরবর্তীতে প্রবীর নিখোঁজের পর তার উদ্ধারের ঘটনায় প্রতিটি আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে থাকে পিন্টু।
এদিকে ব্যবসায়ী স্বপন সাহা প্রায়ই দেড় বছর যাবৎ নিখোজ। এ কারনে সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডাইরী করেছিল তার পরিবার। পরিবারের ভাষ্যমতে প্রবীরের মতই নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হতে পারে স্বপন। তাই স্বপন সাহার অপহরনের ঘটনায় সোমবার (১৬ জুলাই) বিকেলে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় রত্না চক্রবর্তীতে প্রধান আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন স্বপনের বড় ভাই অজিত কুমার সাহা।
তার প্রেক্ষিতে জেলা গোয়ান্দা পুলিশ(ডিবি) গত ১৫ জুলাই রাতে বন্দর এলাকা থেকে স্বপনের ব্যবহৃত দু’টি মোবাইল ফোনসহ রত্না চক্রবর্তী নামে এক নারীকে আটক করেছেন। আর এই রত্না চক্রবর্তীর মাধ্যমেই স্বপনকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল পিন্টু দেবনাথ বলে একটি সূত্রে জানা যায়। পরে আমলাপাড়া থেকে মামুন মোল্লাকেও আটক করেন ডিবি পুলিশ।
মামলার আসামীরা হলেন, কথিত বড় ভাই মামুন মোল্লা, প্রবীর ঘোষের হত্যাকারী পিন্টু দেবনাথ ও তাঁর কর্মচারী বাপন ভোৗমিক বাবু।
স্বপন অপহরন মামলায় আটক রত্মা ও মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে প্রেরণ করা হলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আশেক ইমামের আদালতে আসামীদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।