বিজয়বার্তা ২৪ ডট কম
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা আরএমজি সেক্টরে রপ্তানির উপর কোন প্রকার প্রভাব পড়েনি বলে মন্ত্যব করেছেন নীট গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী নির্মূল করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সব থেকে বেশি সহযোগীতা করতে পারেন গনমাধ্যম ও গনমাধ্যমের কর্মীরা। যারা নিজেদেরকে সম্মান জনক পেশায় নিয়োজিত করেছেন।
বৃহস্পতিবার ২৮ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় বাণিজ্যমন্ত্রনালয়ের সভাকক্ষে প্রেস কনফারেন্সে সেলিম ওসমান এ কথা বলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ এর আহবানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের সফলতা শীর্ষক বিষয়ে এ প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রেস কনফারেন্সে বাণিজ্যমন্ত্রী সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর দেশের সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করেন।
এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের চলমান সংকটের যে দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে অনুমান করা হয়েছিল তা মোটেই সত্য হয়নি। গত পহেলা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গিদের হাতে জিম্মি থাকার পর জাপান এবং ইতালির ১৭জন নাগরিক নির্মম ভাবে হত্যার শিকার হন। যাদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশ হতে পন্য সামগ্রী ক্রয়ের অন্যতম ক্রেতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরামর্শ দাতা। এরপরবর্তীতে ধারণা করা হয়েছিল বিশ্বের তৈরী পোশাক পণ্যের অন্যতম সরবরাহকারী বাংলাদেশ হতে ক্রেতা সম্প্রদায় তাদের ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে নিবে এবং ভবিষ্যতে ক্রয়াদেশ প্রদান করবেনা। তবে সরকারের জঙ্গিবাদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। জঙ্গি দমনে নেওয়া তাৎক্ষনিক কিছু পদক্ষেপ সবাইকে আশস্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকার জঙ্গি দমনের প্রক্রিয়ায় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে নানা ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন। জাপান ইতিমধ্যে জানিয়েছে, জাপান সরকার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে সহযোগিতা করে আসছে এখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনেও সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করবে। ভারত সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ দমনের কৌশলকে একটি উদাহরণ হিসেবে অবহিত করে ভবিষ্যত জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণের সাথে এক হয়ে কাজ করার আশ্বাস দেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশের দাতা সংস্থা এবং রাজনৈতিক প্রধান বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাকে জাতীয় বিষয়ের চেয়ে আন্তর্জাতিক চলমান ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত বলে অবহিত করেন। জঙ্গিবাদ দমনের অন্যতম হাতিয়ার জঙ্গি অর্থায়ন বন্ধ এবং এর উৎস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য অবহিত করার ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেছে।
প্রেস কনফারেন্সে বিকেএমইএ এর পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট বেকারীকে উদ্দেশ্য মূলক ভাবে আরএমজি সেক্টরকে ধ্বংস করে দিতে বেছে নেওয়া হয়েছে। ওই রেস্টুরেন্টে ইটালিয়ান যারা ছিল তারা সবাই আমাদের বায়ার। সেই সাথে দেশের উন্নয়নের জন্য জাপানের একটি সংস্থা কাজ করছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল দেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্থ করা। আমাদের বর্তমান প্রধানন্ত্রী নিজস্ব উদ্যোগে দেশের সর্বস্তরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মাত্র ১৩ মিনিটের অভিযানের মধ্য দিয়ে সমাধান করেন।
আমরা উপলদ্ধি করছি শুরুতে বিষয়টি নিয়ন্ত্রন করার জন্য মিডিয়া তাদের দায়িত্ব থেকে তৎপরতা চালিয়েছেন। পরবর্তীতে র্যাবের প্রধান বেনজীর আহম্মেদ মিডিয়ার সামনে সাক্ষাতকারে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাতে পেরেছেন আমরা ছাড়াও অন্য কেউ লাইভে এসব দেখছে। তখন সাধারণ মানুষ বিষয়টি বুঝতে পারে। যেহেতু পূর্বে আমাদের এমন জঙ্গী হামলার ঘটনার অভিজ্ঞতা নেই সেক্ষেত্রে হয়তো কিছু ভূল হয়েছে অথবা কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মীদের প্রতি অনুরোধ রেখে সেলিম ওসমান বলেন, রানা প্লাজার ঘটনার সময় একই ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থে বিষয় গুলোতে আমাদের আরো সচেনত হতে হবে। উন্নত দেশে এমন বড় ধরনের দূর্ঘটনায় এতো নিখুঁদ ভাবে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়না। তাতে মানুষের মাঝে বেশি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশ গুলোতে এমনটা না করার কারন হচ্ছে প্রথমত শিশু ও বৃদ্ধরা যেন মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এমনকি তারা সাধারণ সড়ক দুর্ঘটনাও সেভাবে প্রচার করে না। তিনি কাউকে দোষারোপ না করে বিষয় গুলোতে সর্তকতা অবলম্বন করার আহবান রাখেন।
সেলিম ওসমান তার বক্তব্যে আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি রাজাকার আলবদরদের গুজবের মাধ্যমে। যার জন্য যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রচরনা থাকে গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দিবেন না।
রানা প্লাজার ঘটনার সময় সাংবাদিকেরা সত্য প্রচারের পরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশকে এবং দেশের সরকারকে দুর্বল করতে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে এ ধরনের গুজব ছাড়ানো হয়েছে। আমরা দেখেছি আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় দফায় শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশ নিতে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। পুলিশ জীবন বিসর্জন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছেন। তারপর কল্যানপুরে গোয়েন্দা তৎপরতায় পুলিশ প্রকৃত জঙ্গীদের প্রতিহত করেছে। ঘটনার পর থেকেই এটা নিয়েও রাজনৈতিক বক্তব্য শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, প্রশ্ন তুলা হচ্ছে কেন পরিচয় জানা হলো না, তাদের হত্যা করা হয়েছে, পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তের আগেই প্রশাসনের কাজ আমরা রাজনৈতিক ভাবে সমাধানের চেষ্টা করি। এসব অবান্তর কথাবার্তা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হলে সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। অথচ বাংলাদেশ ডিজিটাল হওয়াতে তাদের আঙ্গুলের ছাপের মাধ্যমে তাদের পরিচয় শর্নাক্ত করা হয়েছে এবং তারা যে জঙ্গী বাহিনীর সদস্য ছিল তা প্রমানিত হয়। যে দিন গুলশান এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটে সাধারণ মানুষ সেইদিন রাতভর ঈদের কেনাকাটা করেছে। শুধুমাত্র ওই এলাকাটি বাদে সারাদেশেই দোকানপাট খোলা ছিল। এতে প্রমানিত হয় যে সরকারের প্রতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। গুলশান ঘটনার দিন বাংলাদেশের মানুষ জানার আগেই বায়াররা আমাদের(আমরা যারা রপ্তানির সাথে জড়িত) ফোন করা শুরু করে। যখন কারখানা গুলো বন্ধ হওয়ার সময় এবং সরকার ঘোষিত দীর্ঘ ছুটির কারনে বিদেশীরা যার যার কর্মস্থান থেকে ছুটি কাটাতে নিজের দেশে যাওয়ার কথা ওই সময় আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। যাতে বিদেশীরা বাংলাদেশ ছেড়ে একেবারে চলে যায়। ওই মুহুর্তে আতঙ্কের কারনে আমাদের বায়ারদের ও বায়ারের পক্ষের প্রতিনিধিদের নিজ উদ্যোগে বিমান বন্দরে পৌছে দিতে হয়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে আরএমজি সেক্টরের সাথে যারা যুক্ত আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে ব্যবসাটা বেশি পরিচালনা করি। সেখানে ১৫ জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ছুটি থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই সময়টাতে বাংলাদেশে বিদেশীদের উপস্থিতি সংখ্যায় কম। ছুটির পর সেপ্টেম্বর মাসে তারা আমাদের অর্ডার করে অক্টোবর থেকে নতুন শিপমেন্ট করে থাকে। গত ৩০ বছর আমি এ ব্যবসার সাথে জড়িত এবং ৩০টি বছর এভাবেই চলছে। এটাকে পুজিঁ করেও অনেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিরাপত্তার অযুহাত দেখিয়ে আরএমজি সেক্টরকে ধ্বংসের পায়তারা করছে। অথচ এসব ঘটনা রপ্তানিতে বিন্দু মাত্র প্রভাব পড়েনি। ঈদের ছুটির পর ১০ জুলাই থেকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সব গুলো কারখানা সম্পূর্নভাবে চালু হয়ে যায়। প্রতিদিনই পন্য রপ্তানি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত একটি অর্ডার বাতিল হয়নি। ইতোমধ্যে বায়াররা মনোবল ফিরে পেয়েছেন। আমাদের আশ্বস্ত করেছেন তারা আরো অর্ডার প্রদান করবেন প্রয়োজনে তারা বাংলাদেশে আসবেন। তারা বর্তমান সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছেন। এতো তড়িৎ গতিতে বিশ্বের উন্নত দেশ গুলোও ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি।
তিনি আরো বলেন আমরা বঙ্গবন্ধু ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা এনেছি। এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আহবান বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের আলেমগন লিখিতভাবে জঙ্গীবাদের ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন কোন অবস্থাতেই এগুলো ইসলামের কর্মকান্ড না। সে সকল বাবা মায়ের সন্তানেরা এ জঘন্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত হয়েছে সেই সকল বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের লাশ টুকু নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। এখনও যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের বাবা মায়েরাই অভিযোগ তুলে ধরে পুলিশকে তথ্য দিচ্ছেন। সুতরাং এর থেকে বড় ঐক্য আর কিছু হতে পারে বিশ্বে এমন কোন নজির আছে বলে মনে হয়না। সুতরাং সরকার যেভাবে আমাদের সহযোগীতা করছেন তেমনি গনমাধ্যম সহ সকলেই যদি সরকারকে সহযোগীতা করেন তাহলে খুব অল্প সময়ের ভেতরে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গী নিশ্চিহ্ন হবে বলে বিশ্বাস করি। সবার থেকে বেশি সহযোগীতা করতে পারেন বাংলাদেশে সম্মান জনক পেশা সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত। অনেকেই আছে যাদের অভিজ্ঞতা কম অথচ বিভিন্ন টকশোতে গিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে মনগড়া বক্তব্য উপস্থাপন করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার হচ্ছে বলে আমি মনে করি। এ বিষয় গুলোকে সাংবাদিকদের অবশ্যই রাষ্ট্রের স্বার্থে খেয়াল রাখতে হবে।
কনফারেন্স শেষ করার পূর্বে বাণিজ্যমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত হওয়ার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাব। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উন্নয়ন সারা বিশ্বের জন্য একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পোশাক শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান হবে।
এর আগে বাণিজ্যমন্ত্রী দীর্ঘ সময় দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন গুলোর নেতৃবৃন্দের সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ সময় খোলামেলা আলোচনা করেন।
প্রেস কন্ফারেন্সে আরো উপস্থিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, এফবিসিসিআই এর সভাপতি মাতলুব আহমেদ, বিটিএমএ এর সভাপতি তপন চৌধুরী, বিকেএমইএ’র ২য় সহ-সভাপতি মনসুর আহমেদ, বিকেএমইএ’র সাবেক ১ম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, এমসিসিআই এর সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএ’র ১ম সহ-সভাপতি মইনুদ্দিন আহমেদ, বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, এবং অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ তাদের বক্তব্যে প্রায় একই বিষয় গুলো তুলে ধরেন।