বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
যশোর পুলিশের প্রকাশ করা ‘জঙ্গি তালিকায়’ এক নম্বরে থাকা কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না বাড়িতে ফিরেছেন। সোমবার ভোরে নববধূ ও শ্বশুরপক্ষের তিন আত্মীয়সহ বাবার সঙ্গে শহরের শঙ্করপুরের বাসায় আসেন। পরে বেলা ১১টার দিকে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীকে নিয়ে মুন্না কোতয়ালী থানায় হাজির হন। পুলিশের দাবি, এখন থেকে মুন্না পুলিশ হেফাজাতে থাকবে। মুন্নার অজ্ঞাতবাস সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে। তারপর আইনগত ব্যবস্থা নাকি পরিবারের হাতে ফেরত, তা নির্ধারণ করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ১১টার দিকে মুন্না কোতয়ালী থানায় আসেন। তার সঙ্গে এ সময় বাবা-মা-ভাই ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা ছিলেন। থানায় হাজির হলেও পুলিশ তাকে আটক করেনি। পরে বেলা পৌনে একটার দিকে থানায় আসেন পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান। তিনি থানার অফিসার, মুন্না ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, মুন্নার অজ্ঞাতবাস সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নেওয়া হবে। তারপর আইনগত ব্যবস্থা নাকি পরিবারের হাতে ফেরত, তা নির্ধারণ করা হবে।
থানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এসপি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘মুন্নার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়রি করে বলা হয়েছিল সে নিখোঁজ, জঙ্গি তৎপরতায় সংযুক্ত হতে পারে। পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকেরা খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে প্রায় তিন বছর মুন্নার খোঁজ নেই। ফলে তাকে জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত বলে ধরে নেয় পুলিশ।
পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান আর বলেন, এখন মুন্না পুলিশ হেফাজতে থাকবে। তার বিষয়ে পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থা যাচাই-বাছাই করবে। নির্দোষ হলে তাকে পরিবারের হেফাজতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আর দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী তাকে আইনগত সহায়তাও দেওয়া হবে বলে জানান এসপি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে যশোরের নয়টি থানায় মোট ১১৪টি সাধারণ ডায়রি হয় সন্তান বা স্বজনদের নিখোঁজের বিষয়ে। যশোরে নিখোঁজের ব্যাপারে সাধারণ ডায়রি হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচ জন জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এরা হলেন, যশোর শহরের শঙ্করপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার সোবহানের ছেলে কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না (২৪), শহরতলীর কিসমত নওয়াপাড়া এলাকার কাজী হাবিবুল্লাহর ছেলে ফজলে রাব্বি (২১) ও শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাছি গ্রামের আওরঙ্গজেবের ছেলে মেহেদি হাসান জিম (১৯)। অন্য দুই ‘জঙ্গি’ হলেন শহরের ধর্মতলা মোড় এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে রায়হান (২১) ও মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের হাসান আলী গাজীর ছেলে জিএম নাজিমউদ্দিন ওরফে নকশা নাজিম (৪২)। ইতিমধ্যে যশোর পুলিশ জঙ্গি হিসেবে দাবি করে যে পাঁচজনের নাম ও ছবি দিয়ে পোস্টার বের করেছে। মুন্নার অবস্থান সেই তালিকার এক নম্বরে। কামরুজ্জামান তুহিন ওরফে মুন্না যশোর শহরের শঙ্করপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার চা-দোকানি আবদুস সোবহানের ছেলে। বছর তিনেক আগে তিনি বাড়ি ছাড়েন।
মুন্না দাবি করেন, তিনি জঙ্গি নন। যশোর এসে শুনছেন পুলিশ তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য নাম-ছবিসহ পোস্টার ছেপেছে। যশোর পুলিশের ছাপানো জঙ্গি তালিকা সম্বলিত পোস্টারে নিজের নাম ও ছবি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুন্না। মুন্না জানান, বছর তিনেক আগে তিনি মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে বাসা ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে তিনি বছর দুয়েক কাজ করেন ইসলামবাগ এসি মসজিদ গলির জনৈক ডিশ মাহমুদের প্লাস্টিক কারখানায়। পরে জিঞ্জিরা খেজুরবাগ বালুরচর এলাকায় রফিকের ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করেন। সেখানে আলাপ হয় বাংলাবাজারে বই সাপ্লায়ার মনির খানের মেয়ে ইয়াসমিন আক্তারের সঙ্গে। প্রথমে তাদের মধ্যে প্রেম, পরে আনুষ্ঠানিক বিয়ে। সোমবার নববধূ ইয়াসমিন, এক শ্যালিকা ও দুই নানি-শাশুড়িকে নিয়ে বাবার সঙ্গে যশোর ফিরেছি বলেন মুন্না। কোনো ধরনের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে আমি জড়িত নই।
বাবা সোবহানের দাবি, আইপিএল জুয়ায় জড়িয়ে পড়ায় মায়ের বকুনি খেয়ে মুন্না বাড়ি ছাড়ে। সে কোনো জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত নয়। দেশে জঙ্গি তৎপরতার দেখা দিলে স্থানীয় কাউন্সিলর গোলাম মোস্তফা তাকে থানায় নিয়ে যান ছেলে নিখোঁজের ব্যাপারে সাধারণ ডায়রি করতে। (যশোর কোতয়ালী থানা ডায়রি নম্বর ৩৭৮। তারিখ ১০.০৭.২০১৬)। এর পর কোতয়ালী থানার একজন দারোগা এলাকায় তদন্তে আসেন।
সোবহান শহরের শঙ্করপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার জনৈক মুরাদ হাজির বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে সপরিবারে বসবাস করেন। তারা শরীয়তপুরের মানুষ। বাবার কর্মসূত্রে যশোর আগমন। ভাঙাড়ির কারবার থেকে শুরু করে রিকশা চালানো পর্যন্ত সবই করেছেন।
তিনি বলেন, শারীরিক সমস্যার কারণে এখন আর ভারি কাজ করতে পারেন না। তাই এলাকায় একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার ছেলে-মেয়ের বাবা সোবহান। মেয়ে দুটিকে বিয়ে দিয়েছেন। আর ছেলে দুটি বাবার সামর্থহীনতায় নিজেদের চেষ্টায় অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখেছে। বড় ছেলে মুন্না এইচ এস সি পাশ করার পর ডিগ্রি ভর্তি হয়েছিল। এর আগে সে মামার ভাঙাড়ির দোকানে কাজ করে লেখাপড়া চালিয়েছে। পরে পড়াশুনা ত্যাগ করে ইজিবাইক চালাতো। আর ছোট ছেলে আবদুল আহাদ যশোর এমএম কলেজে বিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
এলাকার তার কথিত জঙ্গি তৎপরতা সম্বন্ধে এলাকাবাসী সন্দিহান। মুন্না দোষী না নির্দোষ, সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এলাকাবাসী তা সাব্যস্ত করতে পারছেন না।
থানায় অবস্থানকালে মুন্না সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মা আমার মুখ দেখতে না চাওয়ায় ক্ষোভে-অভিমানে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যাই। সেখানে কাজ-কর্ম করে জীবন চালাচ্ছিলাম। এর মধ্যে ইয়াসমিন আক্তার নামে একটি মেয়ের সাথে পরিচয় হয়। জড়িয়ে পড়ি প্রেমের সম্পর্কে। পরে তাকে বিয়ে করি।’
‘সম্প্রতি স্ত্রীকে বাড়িতে আনার জন্য মায়ের কাছে ফোন করি। মা আমার কণ্ঠ শুনে কান্নাকাটি করেন। পরে ছোটভাই আহাদকে বিয়ের কথা বলি। তখন সে আমার ঠিকানা জানতে চায়। ঠিকানা বলার পর আব্বা এসে আমাকে আজ সস্ত্রীক যশোরে নিয়ে আসে’।
মুন্নার ছোটভাই যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছাত্র আবদুল আহাদ বলছেন, জিডিতে আমরা যা লিখতে চেয়েছিলাম, পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। পুলিশ নিজ ইচ্ছামতো জিডি লিখেছে, যেখানে হয়তো আমার ভাইকে জঙ্গি হিসেবে সাব্যস্থ করা হয়েছে। আবদুল আহাদ আরো বলেন, ভাই ফিরে আসায় আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে আরেকটি জিডি করতে চাই। জিডি লিখেও এনেছি। কিন্তু ডিউটি অফিসার জিডি নিচ্ছেন না। ওসি সাহেব থানায় না থাকায় তিনি এখন জিডি নিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বিকাল চারটার সময় কোতয়ালী থানা ওসি মোঃ ইলিয়াস হোসেন বলেন এমন ঘটনা আমার জানা নেই।