এম এস ইসলাম আরজু,বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার বিয়াড়া গ্রামের মেয়ে মাহবুবা হক (চাঁদের কনা)। নয় মাস বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরন করেন তিনি। স্বাভাবিক চলাচল করতে না পারলেও জীবন প্রতিযোগিতায় থেমে থাকেননি। নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে ফুটিয়ে তুলেছে হাজারো প্রতিকুলতা পেরিয়ে। তার জীবন চিত্র ঘটনাবলির করুন কাহিনী ও সাফল্যের কথাগুলো জানতে পারি তার সাথে একান্ত কথোপকথোনে। আমাদের সকল পাঠক ও শুভাকাঙ্খিদের জন্য চাঁদের কনার কষ্ট ও সফলতার কথাগুলো বলতে চাই, বলতে চাই তার জীবনের চরম ব্যস্তবতার কথা।
বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন চাকুরীজীবি ছিলেন। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন চাঁেদর কনা। বাবা-মার কর্মব্যস্ততার কারনে পোলিও টিকা খাওয়ানোর অভাবে নয় মাস বয়সেই পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। এই পঙ্গুত্ব চাঁদের কনার জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে, ঠিক যেমনি রাতের আলোকিত পূর্নিমা চাঁদকে মেঘের আবছায় ঢেকে দেয়। কিন্তু চাঁদকে কালো মেঘ যতই ঢেকে রাখুক না কেন চাঁদ তার আলোয় আলোকিত হবেই এটাই বাস্তবতা। ঠিক তেমনি চাঁদের কনা তার প্রতিভা ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়।
পোলিও-তে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন চাঁদের কনা। অন্য সবার মত দৌড় ঝাপ, খেলাধুলা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তার জীবন হয়ে পড়ে গৃহবন্দী। শারীরিক ভাবে কিছুটা অস্বাভাবিক হওয়ায় কেউ তাকে পছন্দ করত না। আশেপাশের লোকজন ও তাকে ঘর থেকে বের হতে বারন করতো, কারন অন্য ছেলে-মেয়েরা যেন তাকে দেখে ভয় না পায়। সে অবাক দৃষ্টিতে চরম এক শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর চোখের জল ফেলত নিরবে। সে তখনও বুঝতে পারেনি কেন এমন হল তার জীবন ? কেন সে সবার চেয়ে আলাদা ? কেনই বা তাকে কেউ খেলার সাথী করে নেয় না ? আর জোটেনা কোন বন্ধু ?
পায়ে ভর দিয়ে চলাচল করতে না পারায়, দুটো হাত তার সহায়ক হয়ে উঠে। সে হাতের উপর ভর দিয়ে চলাচল করতো। প্রথম দিকে স্কুলে ভর্তি হতে না পারলেও অবশেষে নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শুরু হয় তার শিক্ষা জীবন। সব সময় স্কুলে যেতে না পারলেও পড়ালেখায় সে বেশ ভালোভাবেই প্রাইমারী, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স ও সর্বশেষ তিনি ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে মাস্টার্স-এ প্রথম শেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে পড়াশোনা শেষ করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। যেমন – সংগীত চর্চা, কবিতা আবৃত্তি, সংবাদপত্র পাঠ, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, অভিনয়, গল্প বলা, কম্পিউটার দক্ষতা, দাবা, কেরাম জীবন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে বেশ কয়েকটি চ্যাম্পিয়ন পুরস্কারও ছিনিয়ে এনেছেন তিনি।
তিনি বলেন – প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সবাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে চায় না। আমরা নাকি আমাদের সমাজের বোঝা মাত্র। আমাদের দিয়ে নাকি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন কল্যাণকর কাজ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমাদের জন্য নেই কোন স্থানে বিকল্প ব্যবস্থা। চলাচলের ক্ষেত্রে হুইল চেয়ার দিয়ে সহজেই যে কোন স্থানে বা উঁচু ভবনে উঠার ব্যবস্থা নেই। স্কুল, কলেজ ও পরিবহনে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য নেই কোন সহজ ব্যবস্থা। নেই শৌচাগারের ব্যবস্থাও। আমি আপনাদের মাধ্যমে আবেদন রাখতে চাই অন্তত স্কুল ও কলেজ গুলোতে প্রতিবন্ধী মানুষদের কথা চিন্তা করে হুইল চেয়ারে চলাচলের জন্য ও প্রবেশগ্রোম্য শৌচাগারের জন্য যেন ব্যবস্থা করা হয়। যাতে আমাদের মত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনায়াসে পড়ালেখার জন্য সুযোগ পায়।
চাঁদের কনার একমাত্র ভরসা ছিলেন তার মা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস অনার্স শুরুর প্রথম দিকেই তার মা মারা যায়। মা মারা যাওয়ার পর শারীরিক-মানসিক ও অর্থ কষ্টে পড়ে যান তিনি। তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকুরী খুঁজতে থাকেন। পরিবারের পক্ষে সম্ভব ছিলনা তার খরচ চালানো। তাই পড়াশোনা চালানো ও জীবন বাঁচানোর তাগিদে বিভিন্ন স্থানে চাকুরীর সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু কেউ তার যোগ্যতার মূল্যায়ন ও মানবিক দিক বিবেচনা করেও একটু সহানুভুতির হাতও বাড়িয়ে দেয়নি। তবুও চাকুরী না পাওয়ার ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েনি তিনি। সে তার চেষ্টা চালিয়ে যায়। অবশেষে মাই টিভি চ্যানেলে চেয়ারম্যান – জনাব নাসির উদ্দিন সাথী সাহেবকে তার পরিকল্পনা জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। তখন সাথী সাহেব তার সামজিক অবস্থান এবং মেধার মুল্যায়ন করতে তার প্রতিষ্ঠানে চাকুরী ও টিভি প্রোগ্রাম করার সুযোগ করে দেন। চাঁদের কনা প্রায় তিন বছর মাই টিভিতে নিয়মিত ভাবে প্রতিভাবান প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে “আমরাও পারি” নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেছেন। সে বেশ দক্ষতা ও সুনামের সহিত প্রোগ্রামটি গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা করেছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন আমি নিজে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ তাই আমি জানি প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ জীবনটা কত অসহায়, আর কতটা কঠিন। তারা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অবহেলিত। তাই আমি চাই প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে কিছু করতে। যাতে তাদের জীবনের না বলা কথাগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে পারে এবং সবাই যেন তাদের অবহেলা না করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের জীবন গল্প নিয়ে আমি আবার নতুন করে টিভি প্রোগ্রাম শুরু করতে চাই। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমার এই মহৎ পরিকল্পনাটাকে বাস্তবে রুপান্তর করতে পারি। আর যদি পারেন আমার প্রোগ্রামের জন্য আপনাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করার সুযোগ করে দেন এটাই আমার কাম্য। আমি একটি কথাই জানি, নিজ ইচ্ছা শক্তিই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কোন প্রতিবন্ধকতাই তার গতি রোধ করতে পারেনা, যদি আল্লাহ্র রহমত থাকে।
সুতরাং, এখন তার দরকার একটি শক্তিশালী সহযোগিতার হাত, যে হাত তাকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি কর্মময় জীবন উপহার দিবে এবং তার যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন করবে। আমার বিশ্বাস, সুযোগ আর সহযোগীতা পেলে চাঁদের কনাও একদিন স্টিফেন হকিংস্-এর মত উজ্জল দৃষ্টান্ত হতে পারে।