দেশে আম উৎপাদনে ঘটবে বিপ্লব, সারাবছরই মিলবে আম, জেলার অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা
নতুন সুস্বাদু অমৌসুমী আম
আশরাফুল ইসলাম,চাঁপাইনবাবগঞ্জ,বিজয় বার্তা ২৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের জেলা, আমের রাজধানী যে নামেই ডাকা হোকনা কেন, এ জেলার আমের খ্যাতি রয়েছে দেশ জুড়েই। জেলার অর্থনীতির বড় নিয়ামকই হচ্ছে আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাখ লাখ আম গাছে এখন মুকুলের সমারোহ। যেদিকেই চোখ যাবে সেখানেই দেখা মিলবে আমের সারিসারি গাছে ফুটে আছে আমের মুকুল। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে কয়েক মাস বাদেই এই সব গাছে ফলবে আম। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) কয়েকটি গাছে এখনি দেখতে পাবেন পরিপক্ক আম। কাঁচা আম ছাড়াও পাকা আমও রয়েছে কয়েকটি গাছে। আবার ওই একই গাছে ছোট আমের গুটিও দেখা মিলবে, সেই সাথে ওই গাছেই কয়েকটি ডালে মুকুলও ফুটে থাকতে দেখতে পেয়ে আপনি কিছুক্ষনের জন্য হলেও আশ্চর্য হবেন। এর আগে ডিসেম্বর ও ফেব্রুয়ারী মাসে কয়েক দফা ওই গাছ থেকে পাকা আমও পাড়া হয়েছে। আর এখনকার কাঁচা পরিপক্ক আম গুলো আর ১০-১৫ দিনের মধ্যেই পাকবে বলে জানিয়েছেন আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। আম গবেষণা কেন্দ্রের এ কয়েকটি অমৌসুমী আম গাছ অনেক বেশি আশাবাদী করে তুলেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট ও আম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের। এ গাছগুলোর এ বৈশিষ্ট্য স্থায়ী হলে দেশে আম উৎপাদনে বিপ্লব ঘটবে সেই সাথে আশাবাদ বিজ্ঞানীদের। ফলে ফল প্রেমীরা সারাবছরই নিতে পারবেন আমের স্বাদ। আর জেলার আম ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন দেখছেন আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিতেও নতুন দিগন্তের সুচনা হবে আমের এ নতুন জাতকে ঘিরেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের তত্ত্বাবধানে অমৌসুমের আম নিয়ে গবেষণা পরিচালনাকারী আম গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জমির উদ্দীন জানান, গবেষণার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্নস্থান থেকে সংগ্রহ করা গাছের সায়ন থেকে চারা উৎপাদন করে গবেষণা কেন্দ্রে লাগানো হয় ২০০২ সালে। এর মধ্যে ্কটি গাছে মে মাসে দেখা যায় মুকুল ধরতে। ওই গাছের আম পাকে সেপ্টেম্বর মাসে। কয়েক বছর ধরে এ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি ওই গাছের সায়ন নিয়ে কয়েকটি চারা কলম লাগান ওই ২০১২ সালে। ২০১৫ সালে দেখা যায় ব্যতিক্রমী ঘটনা । ২০১২ সালে লাগানো গাছে আগষ্ট মাস জুড়ে এসেছে তিন ধরণের মুকুল। আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের প্রথমে, দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে ও তৃতীয় সপ্তাহের শেষে তিন বারে এসেছে মুকুল। অন্যদিকে আগের মাতৃগাছে সেপ্টেম্বরে আম পেরে নেওয়ার পর এক মাস পরেই আবারো মুকুল ধরে অক্টোবরে। আম বিজ্ঞানী জমির উদ্দীন বলেন, সাধারণত দেখা যায়, যে গাছের সায়ন নিয়ে চারাকলম করে গাছ হয়, সেই গাছ মাতৃ গাছের গুণাগুণ বহন করে। কিন্তু তিন বছর বয়সী দুটি গাছে মুকুল ধরলো আগষ্ট মাসে তিন বারে। এ দুটি গাছের কিছু আম পেকেছে গত ডিসেম্বর মাসের ৬,৮,২৪ ও ২৮ ফেব্রুয়ারিতে। এখনো গাছে আছে ২টি পাকা আম। বাকি আম পাকবে আর ৭-৮দিনের মধ্যে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে মাতৃগাছের আম পাকবে মার্চের শেষ দিকে। বিস্ময়কর ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে আমের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রেও। মাতৃগাছের আম টক ও আশ যুক্ত। কিন্তু নতুন গাছের আম সুস্বাদু, দেখতেও আকর্ষণীয়। গাছেই হলুদাভ রং ধারণ করে। মিষ্টতা ১৮ থেকে ২০ ভাগ। খাদ্যাংশ ৭৮ ভাগ। এ আমের অন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি তেমন রসালো নয়। দানা দানা ভাব আছে। যা বিদেশীদের কাছে পছন্দনীয়। ইচ্ছা করলেই যে কেউ এই আম কেটে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করতে পারবেন। ইতিমধ্যেই এ আমের স্বাদ গ্রহণ করে প্রশংসা করেছেন এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ’র উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান আকন্দ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) জালাল উদ্দীন, পরিচালক (কন্দাল ফসল) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ জাহিদুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক সাজদার রহমান। আম বিজ্ঞানী জমির উদ্দীন জানান, জিনগত পরিবর্তনের কারণেই মাতৃগাছের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নতুন গাছের বৈশিষ্ট্যের মিল না হয়ে পরিবর্তন দেখা দেয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় একে ‘মিউটেশন’ (গঁঃধঃরড়হ) বলা হয়ে থাকে। এটা এক ধরণের বিস্ময়কর ঘটনা। আম গবেষণা কেন্দ্রের অমৌসুমী এই আমের জাতের খবর অনেকেই জানতে পেরে আম গবেষনা কেন্দ্রের গবেষকদের সাথে যোগাযোগ করছেন, এই রকমই একজন কাউসার এ রিপন নামে শাহীবাগ এলাকা এক তরুন জানান, তিনি জেলা প্রশাসকের ফেসবুক পেজে আমের বিষয়টি জানতে পেরে, আম গবেষনার গিয়ে গাছটি দেখে এসেছেন। তিনি বলেন আমি অপেক্ষায় আছি, কখন নতুন এই জাতটি অবমুক্ত করা হবে আর আমরা এর চারা সংগ্রহ করে বাগান করতে পারব। নতুন এই আমের গবেষনার বিষয়ে জানতে পেরে নতুন স্বপ্নে কথা জানিয়েছেন, জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাট্রিজ এর সভাপতি আব্দুল ওহেদ, তিনি বলেন, আম মৌসুমে জেলার এক হাজার কোটি টাকার বেশি বানিজ্য হয়। এই বানিজ্যকে ঘিরে জেলার অনেকে স্ববলম্বী হয়েছেন। এমনকি একমাত্র আয়ের উৎসও এটি অনেকের। তিনি জানান, নতুন এই জাতের আমের বিষয়টি আমি শুনেছি, এটি যদি সফল হয়, তবে জেলার আম কেন্দ্রিক তথা জেলার সামগ্রিক অর্থনীতিতে দেখা দিবে নতুন এক সম্ভাবনা। তিনি বলেন এখন এক মৌসুমেই জেলায় আম পাওয়া যায়, এই আম গাছের বাগান গড়ে তোলা সম্ভব হলে, সারাবছরই আম পাওয়া যাবে, সারাদেশেই এই আম আমরা পৌচ্ছে দিতে পারব। ফলে জেলার অর্থনীতি আরো মজবুত হবে। আম গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হামিম রেজা বলেন, উন্নত জাতের মিষ্টি আমের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নতুন এ আমের তুলনা করা যায়। এ আমের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ আম অমৌসুমী আম। যা ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে পাওয়া গেছে। এ বৈশিষ্ট্য স্থায়ী হলে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। প্রথম বারের নতুন এই জাতটিতে আম আসায়, এখনো এটি গবেষনা পর্যায়েই আছে, বর্তমানের বৈশিষ্টগুলো আগামী দুই বছর গবেষনায় বিদ্যমান থাকলে, অমৌসুমী বা বারোমাসি আমের নতুন জাত হিসাবে এই জাতটি অবমুক্ত করা হবে। অবমুক্তের পর চাষী পর্যায়ে এই আমের জাত নিয়ে যেতে এরপরও আরো কিছু দিন সময় লাগবে।