আবু হাসান টিপু,মন্তব্যকলাম, বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর। রোজার মধ্যে হালকা শীতল আবহাওয়ায় দিনটি ছিল প্রতিদিনকার ন্যায় শান্ত ও স্বাভাবিক। সেদিন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে পেন্টেক্স নামক গার্মেন্ট কারখানায় ৮ঘণ্টা কর্মদিবস, ওভার টাইমের দ্বিগুন মজুরিসহ ১৮ দফা দাবিতে শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রাতের অন্ধকারে পুলিশ ও মালিক পক্ষের গুন্ডারা গুলি চালায়। ওই সময় আন্দোলনরত অবস্থাতেই আমজাদ হোসেন কামাল নিহত হয়, সুমি নামে এক নারী শ্রমিকসহ শতাধিকত গুলিবিদ্ধ ও কয়েকশ শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। ঘটনার ১৩ বছর অতিবাহিত হলেও এখনও বিচার হয়নি শহীদ আমজাদ হোসেন কামাল হত্যার।
তৎকালীন সময়ে ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় পাচ শতাধিক গার্মেন্টস শিল্পকারখানা ছিল। ২০০৩ সালের অক্টোবর মাস থেকেই বিসিকে প্যানটেক্স ড্রেস লিমিটেডসহ অন্যান্য আরও বেশ কয়েকটি গার্মেন্টেস প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকগণ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এর মধ্যে প্যানটেক্স ড্রেস লিমিটেড-এর ৩ নভেম্বর এ কারখানার মালামালের শিপমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে সেটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ২ নভেম্বর রাতে সে সময়ের প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টরেট (এনডিসি) সৈয়দ বেলাল হোসেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঞ্জারুল মান্নান ও প্রকাশ কান্তির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ প্যানটেক্স গার্মেন্টের সামনে গিয়ে অবস্থান নেয়। এবং রাতেই সেখানে ডেকে নেয়া হয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্টস শ্রমিক ফডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শ্রমিকনেতা অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে। রাতে ইসমাইল ও শ্রমিকদের সঙ্গে প্রশাসনের লোকজন বার বার বৈঠক করেও কোনো সুরহা করতে পারেনি।
৩নভেম্বর ভোরে পুলিশ ইসমাইলসহ বেশ কিছু শ্রমিককে আটক করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়। দুইজন মেজিষ্ট্রেট-এর নেতৃত্বে ভোর ৫টার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ প্যানটেক্সের সামনে গিয়ে আন্দোলন করা শ্রমিকদের তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। ব্যার্থ হয়ে বিডিআর-পুলিশ ও মালিক পক্ষের গুন্ডারারা একত্রে মিলে শ্রমিকদের অবরোধ ভাংতে লাঠি চার্জ, টিয়ার সেল ও গুলি চালালে শুরু হয় সংঘর্ষ। এবং এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বিসিকসহ ফতুল্লার আশপাশের সকল কল-কারখানাতে। চারিদিকে খবর রটে যায়, বিসিকে পুলিশ ও মালিক পক্ষের সন্ত্রাসীরা গুলি করছে, বেশ কয়েকজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন, হাজার হাজার আহত হয়েছেন শত শত শ্রমিককে হাত পা বেধে ফতুল্লা থানাতে গ্রেফতার করে নেয়া হয়েছে। এই রকমের খবরের ভিত্তিতে উত্তাল হয়ে পরে নারায়ণগঞ্জ। মূহুর্তে গোটা নারায়ণগঞ্জ অচল হয়ে যায়। লাখো লাখো শ্রমিকের পদভারে প্রকম্পিত হয়ে পরে বাংলাদেশ। সকাল ৮টার দিকে হাজার হাজার শ্রমিক পুলিশি বর্বরতার জবাব দিতে ফতুল্লা থানা ঘেরাও করে, এসময় তারা ইসমাইলসহ শ্রমিকদেরকে ছাড়িয়ে আনে।
সংঘর্ষে প্যানটেক্স ড্রেস লিমিটেডের শ্রমিক আমজাদ হোসেন কামাল, সুমীসহ অর্ধশত গুলিবিদ্ধ ও ৬/৭শ জন আহত হন। গুলিবিদ্ধ আমজাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোল ঢলে পরেন। রাত থেকে সকাল অবধি পুলিশ বিডিআর আর মালিকপক্ষের নারকিয় তান্ডবের পর শ্রমিক জনতার অভ্যুত্থানের কারণে তারা কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু পুলিশ সেদিন কৌশলে ময়না তদন্তের নামে আমজাদের লাশ শ্রমিকদের না দিয়ে রাতের আঁধারে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে রাখে।
সংঘর্ষে যানবাহন ও বিভিন্ন কারখানায় হামলা এবং ব্যাপক ভাংচুরের দাবী করে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় ১টি ও ফতুল্লা থানায় ১১টি মামলা হয়েছিল। পরিবহান মালিক, পুলিশ এসব মামলা করে। । অভ্যুত্থানের পরে ৩ ও ৪ তারিখ কার্যতঃ অঘোষিত হরতাল পালিত হয়। পরিবহনতো দুরের কথা ছোট দোকান পর্যন্ত সে দিনগুলোতে খোলা ছিলনা। ৫ নভেম্বর তৎকালীন ১১ দলীয় জোটের আহবানে হাজার হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহনে নারায়ণগঞ্জ শহরে আধাবেলা হরতাল পালন করা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন ক্রিয়াশীল বামপন্থী রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, বাসদ ছাড়া অন্যান্য ক্ষমতাসীনদের দলগুলো ছিল কার্যতঃ গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের ঘোর বিরোধী। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি’র কেডাররা আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময় হামলা যেমন করেছে তেমনী সুযোগ পেলেই হত্যার চেষ্টাসহ ভিন্ন কায়দায় হুমকি ধমকি দিয়ে আন্দোলনকে বানচাল করার চেষ্টা করেছ্।ে আশ্চর্যের ব্যপার হলো তৎকালীন প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগের ভুমিকা ছিল সরকারী দলের মতোই বিতর্কিত। তারাও এই গার্মেন্টস শ্রমিক অভ্যুত্থান বিষয়ে ছিল ঘোর বিরোধী। আর জাতীয় পার্টি, জামাততো তাদেরই চাচাতো, খালাতো আর মাসতুতু ভাই। একথা নিশ্চয় চরম নিন্দুকেরাও স্বিকার করবেন, অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তৎকালীন ১১ দলীয় জোটের নেতৃত্বে জীবনবাজী রেখে কেবলমাত্র বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই সে দিনকার এ আন্দোলন সফলতার মুখ দেখেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা আজ যতটুকু অধিকার প্রাপ্ত হচ্ছেন তার সবটুকুই এই আন্দোলনেরই ফসল।
২০০৩ সালের ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেদিনের ঘটনার পর সরকার ও মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সাথে একটি মীমাংসায় পৌঁছে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল যা পোশাক শিল্পে নিট কারখানার শ্রমিকদের জন্য একটা বড় ধরনের নৈতিক বিজয়। আর এটাই হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে মালিক ও রাষ্ট্রপক্ষের সর্ব প্রথম লিখিত চুক্তি। দাস যুগের ন্যায় নিয়ম নীতিহীন, আইনের সুযোগ সুবিধাহীন ইচ্ছা মাফিক গার্মেন্ট চালালোন বর্বর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে সে দিনকার এই চুক্তির মধ্যোদিয়ে। যদিও সে দিনের সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়েও শ্রমিকনেতাদের অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজও অনেক শ্রমিককে জেল জুলুম সহ্য করতে হচ্ছে।
লেখক: আবু হাসান টিপু, ৩ নভেম্বর গার্মেন্টস শ্রমিক অভ্যুত্থানের অগ্র সৈনিক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক।