স্টাফ রিপোর্টার,বিজয় বার্তা ২৪
৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন ও ঘাতকদের গ্রেফতার করা হবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুনের এমন প্রতিশ্রুতির ৪৮ মাসে গিয়ে ঠেকেছে, তবুও অগ্রগতির কোনো দেখা পাওয়া যায়নি। অনেকটা থমকে আছে এ মামলার তদন্ত।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
থানা পুলিশ থেকে ডিবি হয়ে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। একাধিকবার বদল করা হয়েছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রেও আলামত পাঠিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়েছে। মামলার তদন্ত সংস্থার কাছে সেই পরীক্ষার প্রতিবেদনও এসেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাবের পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত চলছে। সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করে হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চলছে। সব হত্যাকান্ডরই যে দ্রুত রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে যায় তা নয়, স্পর্শকাতর মামলাগুলোতে সময় লাগে। সাগর-রুনি হত্যাকান্ড একটি স্পর্শকাতর মামলা। এ কারণে এর রহস্য উদঘাটনে একটু সময় বেশি লাগছে।
প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। ৪ দিনের মাথায় মামলাটি হস্তান্তর করা হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবির কাছে। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় উচ্চাদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র্যাবে হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকান্ডের ৭৬ দিনের মাথায় ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনঃময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা হয় সাগর-রুনির লাশ। লাশের ভিসেরা আলামতসহ আরো কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ঘটনার দিন থেকেই শুধুই আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দিয়েছিলেন ৪৮ ঘণ্টার প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এ সময় শেষ হওয়ার আগেই তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে ৪৮ মাসে গিয়ে ঠেকেছে। তবুও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির কোনো দেখা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া হত্যাকান্ডের কয়েক দিনের মাথায় ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলামও হত্যাকান্ডের ‘মোটিভ’ নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে মন্তব্য করেন।
সে সময় তদন্ত সংস্থা ডিবি ‘গ্রিল কাটা’ চোরদের দিকে ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে ডিবি তা এড়িয়ে যায়।
এ ছাড়া র্যাবের কাছে তদন্ত হস্তান্তরের পর ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেন। এর মধ্যে ৫ জন রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণকে মহাখালীর বক্ষব্যাধী হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র রায় হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওই বছর আগস্ট মাসে গ্রেফতার করে ডিবি ও র্যাব।
সাগর-রুনি হত্যাকান্ডে তাদের গ্রেফতার দেখানো ছাড়াও সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পালকেও গ্রেফতার দেখানো হয়। কিন্তু দফায় দফায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা র্যাব।
পরে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাগর-রুনির বাসার পলাতক দারোয়ান এনামুল হক ওরফে হুমায়ূনকে ধরতে পারলে হত্যাকান্ডের রহস্যজট খুলে যাবে। এজন্য এনামুলকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এনামুলকে গ্রেফতার করা হলেও খুলেনি রহস্যজট।
এর আগে ২০১২ সালের ১২ জুন ও ১৭ জুলাই ২ দফায় সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। আলামতের তালিকায় ছিল হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি ছুরি, ছুরির বাঁট, সাগরের মোজা, একটি কম্বল, সাগরের পরনের প্যান্ট, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট।
প্রথম দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এসব আলামত থেকে ২ ব্যক্তির সম্পূর্ণ ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। পরে এই ২ ব্যক্তির প্রোফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর, ২ নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও এনামুল ওরফে হুমায়ূন কবীর এবং ৫ ডাকাত রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণের চুল ও লালা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
সে সময় বলা হয়েছিল- এ আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে তদন্তে নতুন মোড় নেবে। রহস্য উদঘাটনে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে।
গত বছর সেই পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও হাতে পেয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা। কিন্তু সেই ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে কারও ডিএএনএর সঙ্গে ম্যাচ করেনি। ফলে অধরাই থেকে গেছে খুনিরা।
হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে মোট ৮ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ জন জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছে। বাকি ৫ জন এখনো কারাগারে। কিন্তু তারাই কি প্রকৃত খুনি কিনা তা এখনো নিশ্চিত করতে পারেননি র্যাব কর্মকর্তারা।
তদন্ত সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মে উচ্চ আদালত থেকে ৬ মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে নিহত সাংবাদিক দম্পতির পারিবারিক বন্ধু তানভীর ও দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল। এর এক মাস পর ৬ জুন জামিন পান মিন্টু।
এদিকে আদালতের নির্দেশে এখনো প্রায় প্রতি মাসেই একবার করে তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দিয়ে যাচ্ছে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
সর্বশেষ তিনি গত ১৮ জানুয়ারি আদালতে তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তী তারিখ রয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি প্রতিবেদনের ভাষা প্রায় একই। আলোচিত এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে জোর প্রচেষ্টা চলছে। প্রযুক্তিগতভাবে ও ম্যানুয়ালি পন্থা অবলম্বন করে আলোচিত এ মামলার তদন্তকাজ চলছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে কয়েকবার। সর্বশেষ র্যাবের কাছে মামলা হস্তান্তরের পর ৩ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছেন। বর্তমানে র্যাবের এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদ মামলাটি তদন্ত করছেন।
এদিকে ৪ বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তারা এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন, খুনিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেফতারের আর কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার হাতে।
মামলার বাদী ও নিহত মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ৪ বছরেও যে হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হয়নি, তা আর কোনো দিন হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু একটাই দুঃখ, এতোবড় একটি ঘটনা ঘটিয়েও খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের শনাক্তই করতে পারলো না পুলিশ-র্যাব।