স্টাফ রিপোর্টার,বিজয় বার্তা ২৪
সম্প্রচার আইন-২০১৬ এর ‘খসড়া’ প্রস্তুত করেছে আইন প্রণয়নে গঠিত উপ-কমিটি। এতে আইন লঙ্ঘনে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং সাত বছরের জেলের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ আইনে ইন্টারনেট-টিভি-রেডিওসহ সম্প্রচারের সকল মাধ্যম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আইনের খসড়ার চূড়ান্ত রূপ দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্প্রচার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে পর্যালোচনা চলছে। চলতি মাসের ২১ তারিখ বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে আইনটির প্রথম পর্যালোচনা বৈঠক হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকা কয়েকজনের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নতুন হতে যাওয়া এ আইন অনুযায়ী টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট টিভি, রেডিও বা অন্য কোনো প্রকারের প্রচারমাধ্যম, ডিজিটাল বা ভিন্ন কোনো প্রকারের সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য সম্প্রচার লাইসেন্স ইস্যু করবে সম্প্রচার কমিশন। এবং আইনের অধীনে লাইসেন্স ফি গ্রহণ এবং আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে জরিমানা আরোপ করার দায়িত্বও থাকছে কমিশনের হাতে।
প্রস্তাবিত এ আইনের ১৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অপরাধ সংগঠনের জন্য অনধিক ৭ বছর মেয়াদের কারাদ- ভোগ করিবে অথবা অনধিক ১০ (দশ) কোটি টাকার অর্থদ-ে দ-িত হইবে অথবা উভয় দ-ে দ-িত হইবে।’
অন্যদিকে ২২(৪-ঘ)-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কমিশন অনধিক ১০০ কোটি জরিমানা প্রদান করিতে প্রশাসনিক আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারিবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রচার আইনের খসড়া উপ-কমিটির প্রধান ব্যারিস্টার তানজিব-উল-আলম বলেন, ‘আইনের খসড়া প্রস্তুত করে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করেছি। আরও একটি বৈঠকের মাধ্যমে কাজ শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।’
প্রথম বৈঠকে আইনের ধারা পর্যালোচনায় কিছু বিষয় সংযোজন-বিয়োজন করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শর্তভঙ্গ করে যারা সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করবে তাদের বিপক্ষে ১০ কোটি টাকার অর্থদ-ের প্রস্তাব করেছি। এই জায়গায় দু-একজন আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু, আমাদের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়ায় তারা সেটা মেনে নিয়েছেন।’
প্রসঙ্গত, বর্তমানে মোট চ্যানেলের সংখ্যা ৪১টি। এর মধ্যে সরকারি তিনটি এবং বেসরকারি ২৪টিসহ মোট ২৭টি চ্যানেল সম্প্রচারে রয়েছে। বন্ধ রয়েছে তিনটি চ্যানেল । আর সম্প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ১৫টি বেসরকারি চ্যানেল।
এসব সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। গত বছরের আগস্ট মাসে সরকার সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রচার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রচার কমিশন
এই আইনের আওতায় ‘সম্প্রচার কমিশন’ নামের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হবে। সম্প্রচার লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে বলেও আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনার থাকবেন পাঁচজন, এদের মধ্যে ন্যূনতম একজন মহিলা সদস্য রাখতে হবে। পাঁচজনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবেন। কমিশনের সদস্যরা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির মর্যাদা ভোগ করবেন। চেয়ারম্যানের থাকবে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির মর্যাদা।
সরকার একটি অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি করে সম্প্রচার কমিশনের কমিশনারদের নিয়োগের জন্য মনোনয়ন দেবে এবং রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে নিয়োগ দেবেন। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ হবে ৪ বছর। তবে, কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের পুনঃনিয়োগ দেওয়া যাবে না বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
কমিশনারদের যোগ্যতার ক্ষেত্রে সম্প্রচার মাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, নারী প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং আইনজ্ঞের কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের ১৫ বছরের অভিজ্ঞতার কথাও বলা হয়েছে।
কমিশনে প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থাপন করার কথা বলা আছে। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে শাখা অফিস স্থাপন করতে পারবে।
কমিশনের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
সম্প্রচারকারীদের জন্য গাইডলাইন তৈরি। গাইডলাইন অনুযায়ী সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না তা তদারকি। প্রয়োজনে সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ ও শর্ত প্রণয়নের কাজ করবে কমিশন।
এ ছাড়া টেলিভিশন, বেতার, ইন্টারনেট টিভি, রেডিও বা অন্য কোনো প্রকারের প্রচারমাধ্যম ডিজিটাল বা ভিন্ন কোনো প্রকারের সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য সম্প্রচার লাইসেন্স ইস্যু করা কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এবং আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্স ফি গ্রহণ ও আইনের কোনো বিধান লক্সঘন করলে জরিমানা আরোপ করার দায়িত্বও পালন করবে এই কমিশন।
সম্প্রচার আইনের খসড়া উপ-কমিটির অন্যতম সদস্য মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের উপ-কমিটির কাজ শেষ করে মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় সেটি পর্যালোচনা করে আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নেবে।’
লাইসেন্স হস্তান্তর ও নবায়ন
আইনের ২০ (১) ধারা অনুযায়ী, ‘কমিশনের লিখিত পূর্ব সম্মতি ছাড়া কোনো লাইসেন্স প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্য কারো কাছে হস্তান্তরযোগ্য হইবে না।’ উপধারা (২) অনুযায়ী, ‘যেকোনো লাইসেন্সের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হস্তান্তর সকল ক্ষেত্রেই বাতিল ও অকার্যকর হইবে।’
২১ ধারা অনুযায়ী, এই আইনের অধীন প্রদত্ত লাইসেন্স এই আইনের বিধিমালা দ্বারা নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে নবায়ন করা যাইবে, তবে বিধিমালা না থাকিলে কমিশন প্রশাসিনক আদেশের মাধ্যমে তাহা নির্ধারণ করিবে।
যোগ্যতার মানদ-, লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত
ন্যূনতম দুই বছর বা তার বেশি কারাদ-ে দ-িত এবং উক্ত দ- থেকে মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে। আদালত দেউলিয়া ঘোষণা করা পর সেই দায় হতে অব্যাহতি না পেলে। কমিশন কোনো কারণে লাইসেন্স বাতিল করার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে। ঋণখেলাপি চিহ্নিত হলে বা কমিশন ঘোষিত অন্য কোনো মানদ-ে উত্তীর্ণ না হতে পারলে কোনো আবেদনকারী লাইসেন্সের পাওয়ার যোগ্য হবেন না।
উল্লিখিত মানদ- গোপন করে কেউ লাইসেন্স নিলে কমিশন তা জানার পর সেই লাইসেন্স বাতিল কিংবা স্থগিত করতে পারবে। তবে, কমিশন চাইলে অভিযুক্ত সম্প্রচার কর্তৃপক্ষকে ৩০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিবে। নোটিশের জবাব পাওয়ার পর কমিশনের বিবেচনামতো সম্প্রচার বন্ধ, সংশোধনমূলক ব্যবস্থা করতে পারে বা শর্ত দিয়ে অনুশাসন জারি করতে পারবে।
এই ক্ষেত্রে কমিশন অনধিক ১০০ কোটি টাকা জরিমানার নির্দেশ দিতে পারবে [ধারা-২২(৪)]। এ ধারার কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে কমিশনের বিপরীতে আদালতে যাওয়ার পথও বন্ধ রাখা হয়েছে আইনে।
ব্যতিক্রম
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সরকারি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে লাইসেন্স নিতে হবে না। এ ক্ষেত্রে কমিশন কোনো ব্যক্তিকে অব্যাহতি দিতে বা সম্প্রচার যন্ত্রকে আলোচ্য আইনের আওতামুক্ত রাখার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইনের পর্যালোচনা শেষ হলে মন্ত্রণালয় আইনটি আরেক দফা পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠাবে। ভেটিংয়ে কোনো সমস্যা ধরা না পরলে সেটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ার পর আইন প্রণয়নের জন্য তা সংসদে বিল আকারে উত্থাপন হবে।