স্টাফ রিপোর্টার,বিজয় বার্তা ২৪
নন্দিনীর কথা মনে আছে? রবি ঠাকুরের নন্দিনী। যক্ষপুরীতে পাষাণ রাজার জাল ছিঁড়ে আলোর দরজা খুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখান যে নন্দিনী। সুন্দরের প্রতীক হয়ে যক্ষপুরীতে আসেন তিনি, বিষুর সঙ্গে বসে পৌষের গান শোনান। সেই ঈষাণীপাড়ার নন্দিনীর কথাই বলছি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩০ বঙ্গাব্দে শিলংয়ের শৈলবাসে ‘রক্তকরবী’ রচনা করেন। তখন এর নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’। ১৩৩১ সনের আশ্বিন মাসে প্রবাসীতে নাটকটি ‘রক্তকরবী’ নামে প্রকাশিত হয়। এরপর রঙ্গমঞ্চে নন্দিনী সেজেছেন অনেকেই। আবার কেউ নিজেকে নন্দিনী ভেবে জীবনকেই সাজাতে চেয়েছেন। অন্ধকারে আলোর প্রতীক হয়ে নন্দিনীর আবেদন আজও প্রবহমান। রবি ঠাকুরের ১৫৫তম জন্মজয়ন্তীতে এই প্রতিবেদনে খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে যুগে যুগে নন্দিনীরূপে অভিনয় করা শিল্পীদের।
‘রক্তকরবী’র কাহিনীতে দেখা যায়, যক্ষপুরীর অন্ধকার থেকে কঠোর শ্রমে সবাই তুলে আনছে তাল তাল সোনা। সেই যক্ষপুরীতে নেই প্রাণের স্পর্শ, সবাই যেন যন্ত্র। নন্দিনী এসে সবার মধ্যে প্রেম জাগ্রত করে, সুন্দরের কথা বলে, পৌষের গান শোনায়। নন্দিনী এসে বলে যায় প্রতাপের মধ্যে নেই পূর্ণতা, প্রেমের মধ্যেই পূর্ণতা। নিজের শেকলের কাছে আমরা দাস। কিন্তু এক সময় সকলের মনে দোলা দেয় নন্দিনীর প্রতি প্রেম। কিন্তু মাটির তল থেকে যে সম্পদ খুঁড়ে আনতে হয় নন্দিনী সে সম্পদ নন। মাটির উপরিতলের প্রাণের রূপই হলো নন্দিনী।
‘রক্তকরবী’ ও ‘নন্দিনী’ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, নাটকটি বাস্তব ঘটনা থেকে লেখা। কেউ বলছেন, নাটকটি কবিগুরু লিখেছেন কল্পনার আশ্রয়ে। এ নাটকের মাধ্যমে রাজা-প্রজার মধ্যকার দেওয়ালটা তুলে দিয়ে মানুষের জয়গান গেয়েছেন তিনি। এখানে নন্দিনী হলো প্রেমের প্রতীক। যক্ষপুরীতে নন্দিনীর এই প্রেমের পরশ রাজা পাননি লোভের জন্য, সন্ন্যাসী পায়নি কুসংস্কারের জন্য আর মজুররা পায়নি নিজেদের শেকলে বন্দী বলে। আবার সবার ভালোবাসার বিপরীতে নন্দিনীর ভালোবাসা শুধু একজনের জন্য। রঞ্জনের মধ্যেই নন্দিনীর প্রেমের দিশা। অথচ রঞ্জনও তার নিজের শেকলে বন্দী। অবশেষে সবাইকে শেকল থেকে মুক্তির ডাক দিয়ে হারিয়ে যায় ঈষাণীপাড়ার রূপবতী মেয়েটি।
দুই বাংলাতেই ‘রক্তকরবী’ বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। আজও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এ নাটকের ‘নন্দিনী’ চরিত্রে অভিনয় করে অনেকেই তারকাখ্যাতিও পেয়েছেন। আবার অনেক তারকারই স্বপ্ন নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করা। এ চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে নানা আঙ্গিকে টিভি নাটক-সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
নাটকটির মঞ্চায়নে বেশ বিপাকেই পড়তে হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কারণ সব চরিত্রের জন্য উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী পাওয়া গেলেও নন্দিনী চরিত্রের জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজনকে পাওয়া গেল। সেই তরুণীটি ছিলেন সিলেটের। রবীন্দ্রনাথ তাকে চূড়ান্ত করেছিলেন। নাম না জানা সেই তরুণীই প্রথম নন্দিনী। কলকাতার বাঘা বাঘা অভিনেত্রীকে পেছনে ফেলে সিলেটের সেই তরুণীই রবীন্দ্রনাথের চোখে প্রকৃত নন্দিনী হয়ে উঠেছিলেন।
‘নন্দিনী’ চরিত্রে অভিনয় করে সবচেয়ে থেকে বেশি আলোচিত হন কিংবদন্তি অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। ভারতে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় ১৯৫১ সালে নাট্যগুরু শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’র মঞ্চস্থ হয়। ওই প্রযোজনায় নন্দিনী চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়কে এখনো ভারতীয় মঞ্চনাটকের সর্বকালের সেরা কীর্তির মর্যাদা দেওয়া হয়। তিনি টানা ১১ বছর নন্দিনী সেজে মঞ্চ মাতিয়েছেন।
তৃপ্তি মিত্র যতদিন নন্দিনী সেজে মঞ্চে উঠেছেন, প্রতিবারই মিলনায়তন থাকত কানায় কানায় পূর্ণ। পরবর্তী সময়ে তার মেয়ে শাঁওলী মিত্রসহ মধুমতি বসু, অনিন্দিতা রায়, বাসন্তী গুহসহ কলকাতার প্রখ্যাত অভিনেত্রীরা এই চরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু কেউই তৃপ্তি মিত্রের মতো খ্যাতি পাননি।
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক সংসদ ‘রক্তকরবী’ মঞ্চায়ন করে। এতে নন্দিনী রূপে দেখা যায় রওশন আরাকে। এরপর ১৯৬১ সালে ঢাকা ড্রামা সার্কেল মঞ্চস্থ করে ‘রক্তকরবী’। এতেও অভিনয় করেন রওশন আরা। এরপর নন্দিনী হন কাজী তামান্না। ১৯৬৯ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় তিনি নন্দিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেন।
বাংলাদেশে নন্দিনী চরিত্রটি প্রথম সার্থকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন দিলশাদ খানম। পাপেটশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের নির্দেশনায় এটি ছিল টিভি নাট্যরূপ। ১৯৭৪ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ‘রক্তকরবী’ নাটকে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করেন দিলশাদ।
নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে আলোচিত হয়েছেন টিভি অভিনেত্রী অপি করিম। ২০০১ সালের ৩০ নভেম্বর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনায় ও নাট্যজন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে ‘রক্তকরবী’। এর আগে মঞ্চে অভিনয় করার খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিল না অপির। তবে নাচ-গানের কারণে অনেকবার মঞ্চ মাতিয়েছেন। সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চে বেশ সাফল্য দেখান অপি করিম।
ঢাকাই নাট্যচর্চার প্রচলিত নিয়ম ভেঙে টিভি অভিনেত্রীকে দিয়ে মঞ্চ অভিনয় করিয়ে নতুন চমক দেখিয়েছিলেন আতাউর রহমান। অবশ্য এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অনেক। তখন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের অনেকেই নন্দিনী চরিত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। শেষ পর্যন্ত অপি করিমকেই বেছে নিয়েছিলেন আতাউর রহমান। অপি ৮৩টি প্রদর্শনীতে অভিনয় করার পর পড়াশুনার জন্য জার্মানিতে চলে যান। এরপর নিয়মিত অভিনয় করেন আবৃত্তি থেকে নাটকে যাওয়া নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। আবার ১০০তম প্রদর্শনীতে অভিনয় করেন অপি করিম। তারপর তাকে ওই চরিত্রে দেখা যায়নি।
বর্তমানে নিয়মিত ‘রক্তকরবী’র প্রদর্শনী করছে প্রাঙ্গণেমোর। এতে নূনা আফরোজ নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকটির নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের অনেকগুলো প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে প্রাঙ্গণেমোর। নূনা আফরোজের অভিনয় দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
টেলিভিশনেও বিভিন্ন সময় নন্দিনী চরিত্রের খ-িত রূপ উঠে এসেছে। নন্দিনী সেজে পর্দায় এসেছেন সাদিয়া ইসলাম মৌ, শশী, তারিন, মিম প্রমুখ। কলকাতা, আগরতলায়ও মঞ্চের পাশাপাশি টিভি পর্দায় দেখা গেছে নন্দিনীদের।