মো: শরীফুল ইসলাম,বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
নারায়ণগঞ্জের সর্বালোচিত সেভেন মার্ডারের আসামী সন্ত্রাসীদের গডফাদার নূর হোসেনকে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। তবে বাংলাদেশে হস্তাস্তর করার আগে ভারতীয় সীমাস্তে বিএসএফের একটি বিশেষ ক্যাম্পে তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। তবে এই জিজ্ঞাসাবাদের পুরো ঘটনা ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তাকে জেরা করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জেরালো চাপের মুখে নূর হোসেন সাত খুনের আদ্যোপান্ত খুলে বলেন। তবে নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বিএসএফ ক্যাম্পে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। বিশেষ সূত্রে নূর হোসেনের জবানবন্দির ওই ভিডিও রেকর্ডের একটি কপি জাতীয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।
সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত আদালতের বাইরে এটিই নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের একমাত্র রেকর্ড- যা এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। সাত খুনের রায় ঘোষণার পর অত্যন্ত গোপনীয় এই ভিডিও রেকর্ডের ৩ মিনিটের সারাংশ একটি বে-সরকারি টেলিভিশন যমুনা এবং যুগান্তরে সোমবার সম্প্রচার করে।
জানা যায়, ৭ খুনের ৪,৫ দিনের মধ্যে প্রভাবশালী এমপি ও আওয়ামীলীগের নেতার সহযোগীতায় গডফাদার নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর পরই ২০১৫ সালের ১৪ জুন তিনি ভারতীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন নুর হোসেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে নূর হোসেন বলেন, আমি সব কইয়া দিমু। আমাকে টিভির টফ শোতে নিয়া যান। সেখানে সব বলব।’
নুর হোসেন আরো বলেন, ঘটনার দিন মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে জানতে চান নজরুল আদালতে গেছে কিনা। তার ফোন পেয়ে নজরুলের অবস্থান জানার জন্য আমি আওয়ামীলীগ নেতা এ্যাড: খোকন সাহাকে ফোন করি। আদালতে নজরুলের উপস্থিতির বিষয়টি খোকন সাহার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে মেজর আরিফকে তিনি জানান- হ্যাঁ স্যার নজরুল কোর্টে আছে। নজরুলকে অপহরণে র্যাবের এত আগ্রহের কারণ কি জানতে চাইলে নূর হোসেন বলেন, র্যাব আরিফ একটা জমি দখলের জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু নজরুলের কারণে আমি সেটা করতে পারছিলাম না। আরিফকে এটা বলার পর র্যাবের পক্ষ থেকে নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা করা হয়। এ জন্য র্যাব আমার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় টাকা-পয়সাও নিয়েছে।
যেভাবে নুর হোসেনের উত্থান শুরু হয় ১৯৮৫-৮৬ সালের ঘটনা। সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ইকবাল গ্রুপের ট্রাকের হেলপার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। অনেক কষ্ট কইরা আমি এই জায়গায় আইছি। ১৮ বছর ধইরা ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এভাবেই তিনি নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে চলে যাচ্ছিলেন উল্ল্যেখ করে নূর হোসেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে আমাকে অনেকবার হত্যার পরিকল্পনা হয়। কিন্তু আমার কাছে সব সময় ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। এর মধ্যে ১২টির লাইসেন্স ছিল। তাই আমাকে মারতে কোনো কিলার সাহস পায়নি।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জে একচ্ছত্র মাদক ব্যবসার কথা অকপটে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে মাদক ব্যবসা শুরু হয় গত বিএনপি আমলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেটা বন্ধ ছিল। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমার লোকজন সেখানে ব্যবসা শুরু করে। ভারতীয় ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি থেকে দিনে কয়েক লাখ টাকা আয় হতো। নুর হোসেন তিনি দাবি করেন, মাদক সা¤্রাজ্য থেকে তার প্রতিদিন যে আয় হতো তার একটি বড় অংক পেত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, র্যাব ও স্থানীয় কিছু গণমাধ্যমকর্মী। যারা টাকা নিতেন তারা সবাই আমার কথামতো কাজ করতেন। বিশেষ করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি আবদুল মতিন আমার কথায় ওঠাবসা করতেন।
তিনি জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নূর হোসেন জানান, ‘নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানেরও ব্যাপক দ্বনদ্ব রয়েছে। এ বিষয়ে আমার কাছে লিখিত এভিডেন্স (প্রমাণ) আছে, যেখানে প্রকাশ্যে শহীদ চেয়ারম্যান বলেছেন- নজরুলকে তিনি পিটিয়ে মেরে ফেলবেন।
ভারতের জেলে বন্দি থাকাবস্থায় দেশে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ হতো তা জানতে চাইলে নূর হোসেন বলেন, প্রথম ৬ মাস আমি ভারতের কারাগারে ভালোই ছিলাম। বাইরে থেকে মাছ-মাংস এনে খেতাম। ভারতের ওই কারাগারটি বিশাল। সেখানে আলু, লালশাক লাগিয়েছি। ফুলকপি, বাঁধাকপির চাষ করেছি। বাংলাদেশ থেকে আমার লোকজন গেলে দেখা সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু ৬ মাস পর একটু অসুবিধা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যের বিষয়ে নূর হোসেন বলেন, এসপি, ডিসি থেকে শুরু করে জেলার প্রায় সব কর্মকর্তার সঙ্গেই তার ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এই খুনের ঘটনা নিয়ে এখন পুরো নারায়ণগঞ্জ খালি হয়ে গেছে। ডিসি, এসপি, র্যাবের সিও এরা সবাই চলে গেছে।
আফসোস করে তিনি বলেন, এই খুনটার কারণে আমি আজ স্ত্রী সন্তান সব হারিয়েছি। আমি শেষ হয়ে গেছি। আমার আর কিছুই নেই। যতটুকু উপরে উঠেছিলাম ততটুকু নিচে পড়ে গেলাম। একজন র্যাব কর্মকর্তার প্রশ্নের উত্তরে নূর হোসেন বলেন, ‘নজরুল আমার শত্রু। তাকে মারতে বলেছিলাম। কিন্তু নজরুলের সঙ্গে আরও ছয়টা মানুষকে খুনের পেছনে আরও শক্তিশালী হাতের ঈশারা রয়েছে। কারণ সিদ্ধিরগঞ্জের রাজনীতিতে আমরা কয়েকজন উপরে উঠে যাচ্ছিলাম। এ জন্য নজরুলের সঙ্গে আরও ছয়জনকে মেরে আমাদেরকেও চিরতরে ঠান্ডা কওে দেয়া হয়।
ভারতে পালিয়ে এলেন কেন এ বিষয় জানতে চাইলে নূর হোসেন বলেন, র্যাবের ভয়ে। কারণ সবাই আমাকে বলল- তুমি পালাও। র্যাব পেলে তোমাকে খেয়ে ফেলবে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে বলল, আপনি পালিয়ে যান। বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে। কোন না¤া^রে ফোন করেছিল জানতে চাইলে নূর হোসেন বলেন, ‘আপনারা শুধু আমার একটা নাম্বরই জানেন। কিন্তু আমার কাছে আরও অন্তত ছয়টা ফোন নাম্বার আছে। ওই নাম্বারগুলোর একটিতে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ফোন এসেছিল। নূর হোসেন আরো বলেন, ভারতের কারাগারে থাকার সময় বাংলাদেশ থেকে তার লোকজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। সেখানে তার বেশ আরাম আয়েশে দিন কেটেছে। এ কারণে তিনি দেশে ফিরতে রাজি ছিলেন না।
নুর হোসেনকে দীর্ঘ ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতের শেষভাগে দু’দেশের সীমান্তে সংযোগস্থল নো-ম্যান্স ল্যান্ডে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন জেলা পুলিশ, তদন্ডকারী কর্মকর্তা, নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবির সদস্য, বিজিবি ও র্যাবের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি দল।
নো ম্যান্স ল্যান্ডে নূর হোসেনকে নিয়ে আসা হলে তাকে রিসিভ করার জন্য এগিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু বিএসএফ পুলিশের হাতে নূর হোসেনকে হস্তাস্তর করতে অস্বীকার করে। এ সময় একজন পদস্থ বিএসএফ কর্মকর্তা জানতে চান, এখানে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) জিয়াউল আহসান উপস্থিত আছেন কিনা কারণ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে জিয়াউল আহসান ছাড়া অন্য কারও কাছে নূর হোসেনকে যেন হস্তাস্তর করা না হয়। পরে জিয়াউল আহসানের নেতৃত্বে র্যাবের পরিচালক (অপস) আবুল কালাম আজাদসহ তিনজন র্যাব কর্মকর্তা নূর হোসেনকে গ্রহণ করেন।
সেখানেও র্যাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সৌজন্য বিনিময়ের পর হস্তাস্তরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। শুরুতেই বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত পাঁচ কপি দলিলে স্বাক্ষর করেন উভয় দেশের কর্মকর্তারা। এ সময় নূর হোসেনকে বিএসএফের একটি গাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়। সই-স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নূর হোসেনকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়। গাড়ি থেকে নামার সময় নূর হোসেন কাঁপছিলেন। এ সময় তার মাথায় হেলমেট ও গায়ে র্যাবের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরানো হয়। এত আনুষ্ঠানিকতা দেখে নূর হোসেন ঘাবড়ে যান। তিনি উপস্থিত কর্মকর্তাদের বলেন, পানি খাব। এক গ্লাস পানি পাওয়া যাবে কর্মকর্তারা তাকে বলেন কোনো ভয় নেই। তুমি শান্ত থাক। শেষ রাতের দিকে নূর হোসেনের হন্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হয়। এরপর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে কয়েকটি গাড়ি নূর হোসেনকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেয় র্যাব।