গৌতম রায়,বিজয় বার্তা ২৪ ডেস্ক
আজ মনে হচ্ছে আমি ভাগ্যগুনে প্রবাসী নই, ভাগ্যদোষেই প্রবাসী। এদেশে অনেক চড়াই উৎড়াই, অভাব অনটন, ত্যাগ সংগ্রাম, জেল জুলুম নির্যাতন ভোগ করে এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু সততার প্রশ্নে কোনদিন কারো সাথে আপোস করিনি। নিজের জন্য নয় অপরের জন্যই উৎসর্গ করেছি জীবনের মুল্যবান ২৫টি বছর। তাই কে আমাকে ঘৃনা করলো বা কে কি বলল সে দিকে তাকানোর সময়ই পাইনা। কারন, সময় রেখেছি তাদের জন্য যারা আমাকে ভালবাসে।
আমি সব সময় বলি, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের সকল অশান্তির মূলে দায়ী আমরা বাংলাদেশীরাই। ২৪ বছর আগে দেখতাম দু’দিনে কেউ তামিল বন্ধু বান্ধব জুটিয়েই বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতো। শ্রমিকরা বেতন নিয়ে ফেরার সময় তামিল ছেলেদের দিয়ে টাকা পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিত। টাকাটা নিত ওরা আর পাসপোর্টটা নিত সেই কুলাঙ্গার। আবার পুলিশের সাথেও সম্পর্ক করে একে ধরায় ওকে ছাড়ায়। কি না করেছে ওরা এদেশে। মালয়েশিয়ার প্রশাসনে যেমন দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে তেমনি কোম্পানীর মালিকগুলোকেও নষ্ট করে লোভী বানিয়েছে এইসব কুলাঙ্গাররা। এখনো তা বন্ধ হয়নি। যার খেসারত আজ শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে। কলিং ভিসা পারমিট নিয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কাউকে বাদ দেয়নি ওরা। সহজ সরল মালয়রা বুঝতো না দুর্নীতি কি এবং কিভাবে এটা করতে হয়। যার কারনে বার বার শ্রমিক রপ্তানীর খরচ বাড়তেই থাকে। আর এ অর্থের যোগান দিতে শ্রমিকদের জমি জমা বিক্রি করে আসতে হয়। আবার গত কলিং ভিসায় সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে মালয়েশিয়ায়। মালিক ম্যানেজারদের ঘুষ বা উপঢৌকন দিয়ে অতিরিক্ত শ্রমিক পাঠিয়েছে একেকটা কোম্পানীতে। এর পর শ্রমিকদের করুন অবস্থা সবারই জানা। এ প্রসঙ্গে পরে বলবো।
যে ছেলেকে মা বাবা পাঠিয়েছিল বিদেশে চাকুরী করে সংসারে হাসি ফোটাতে সে ছেলে এদেশে এসে জড়িয়ে পড়লো মাস্তানী, অপহরনসহ অনেক অপরাধে। কিন্তু এদের সংখ্যা কম হলেও বদনাম হতে থাকে বাংলাদেশের। সৎ, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান হিসাবে শ্রমিকদের সুনাম থাকলেও ওদের কারনে কিছুটা মলিন হতে থাকে। একদিকে বিদেশে রঙ্গ মঞ্চে দেদারসে পয়সা উড়াচ্ছে অপরদিকে পরিবার অপেক্ষায় থাকে কবে টাকা আসবে। আর সে টাকা আদায় করে শ্রমিক প্রতারনা দালালীর মাধ্যমে।
কিন্তু ভাল থাকতে পারেনি ওরা। যে সাপ নিয়ে খেলেছে সে সাপই একদিন তাকে ছোবল মেরেছে। কিন্তু ক্ষতিটা করেছে সবার। স্থানীয়দের এসব অপকর্ম শিখিয়ে চোখ খুলে দিয়েছে। একসময় তামিল ছেলেরা চাকুরী ছেড়ে দিয়ে পথে ঘাটে বাংলাদেশীদের ধরে সব নিয়ে যেত। আজকের ক্ল্যাং বাসষ্ট্যান্ড, পোর্ট ক্ল্যাং, পুচং, মেরু, কাজাং ইত্যাদি এলাকা ছিল বাংলাদেশীদের জন্য আতংকের। অথচ আমি তামিল মেয়ে বিয়ে করার সুবাদে বাতু কেভসের তামিল গ্যাং ষ্টার ও এদেশের প্রশাসনের অনেকে ছিল আমার হাতের মুঠোয়। কোনদিন কোন বাংলাদেশীর অকল্যানে তাদের ব্যবহার করিনি। কিন্তু বহু শয়তানকে শায়েস্তা করেছি। তামিলদের থেকেই ছিনতাইয়ের টাকা পয়সা উদ্ধার করে দিয়েছি বাংলাদেশিকে। কুলাঙ্গার বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। কেউ শ্রমিকদের ক্ষতি করলেই সামনে দাঁড়িয়েছি। প্রতিবাদ প্রতিহত করেছি। যদিও এই শ্রমিক থেকেই দালালের বংশবৃদ্ধি ঘটছে বার বার।
এক সময় দেখলাম সেই কুলাঙ্গারদের অনেকেই এদেশে বিয়ে করে আরো বেপোরোয়া হয়ে গেছে। মালয়েশিয়ায় আজ দালালদের অনেকেই এদেশে বিবাহিত। বিপদে পড়লে স্ত্রীকে সামনে রেখে বেঁচে যায়। ভয়ে শ্রমিকরা কিছু বলতে পারে না। এই অপদার্থরা আমাকেও সবার মতো অসহায় ভেবে হুমকী দেয়। তবে সেটা ফোনে দূর থেকে এভাবে সেভাবে। কিন্তু অনেকে টাকার গরমে বুঝতে পারে না তার মেধা ও পায়ের নীচে মাটি কতটা মজবুত।
১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশীদের ভাগ্যের টানাপোড়েন চলে। জহুর বারুর ঘটনায় ‘বাংলাদেশী খেদাও’ শুরু হয়ে গেল। প্রথম ধাক্কাটা এলো আমাদের দিকে। সে সময় খুব বেশী মালয়েশিয়ায় বিবাহিত বাংলাদেশী ছিল না। তামিল নেতৃত্ব থেকেই বিবাহিতদের বিদায় করতে সরকারকে উস্কে দেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। তাই মিডিয়া খুব বেশী করে আমাকে ফোকাস করতে লাগলো। টিভি’র খবরে, দি ষ্টার, দি নিউ ষ্ট্রেইট টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম হতে থাকলাম আমি। আমার শক্ত জবাব ছিল- আমাকে পাঠিয়ে দিলে একা চলে যাব। আর সুযোগ দিলে স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব পালন করবো। সরকার কি সিদ্ধান্ত নেয় সেটা তাদের ইচ্ছা। সে দিন আমি সরকারের কাছেও নীতির প্রশ্নে নত হইনি। কারন জানতাম সেটা সম্ভব নয়। মালয়েশিয়ার জাতীয় সংসদে মহিলা নেত্রীদের তোপের মুখে পড়ে মাহাথীর সরকার। তাদের বক্তব্য ছিল, সরকারের দায়িত্ব কি সংসার ভাঙ্গা? মালয়েশিয়ার ছেলেরা যদি বিদেশী মেয়ে বিয়ে করে এদেশে থাকতে পারে তাহলে মেয়েরা কেন তাদের বিদেশী স্বামী নিয়ে থাকতে পারবে না? বিজয়টা সেদিন আমাদেরই হলো।
একই সময়ে মালয়েশিয়ার The Sun পত্রিকায় প্রকাশ হয় মালয়েশিয়ার NGO তেনাগানিতার প্রতিবেদন A Shutter Dream. সে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে বাংলাদেশী শ্রমিকদের অবর্ননীয় কষ্ট ও মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো। কম খাইয়ে ও নির্যাতনে বাংলাদেশীদের মৃত্যু হলে লাশ ফেলে দেয়া হতো জঙ্গলে। এ রিপোর্টে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্গনের অভিযোগ উঠে আন্তর্জাতিক মহলে। আর সে রিপোর্টটি মূলত তৈরী করেছিলেন গোলাম আহাদ। তাকে ক্যাম্প থেকে মুক্ত শ্রমিকদের কষ্টগুলো তুলে দিয়েছিলাম আমি। নেপথ্যে আমার অবদান থাকলেও কৌশলগত কারনে আমি নীরব থাকি। কিন্তু যেহেতু তেনাগানিতা সেটি প্রকাশ করেছে তাদের নামে তাই ক্ষুব্দ মাহাথীর সরকার মামলা করে তেনাগানিতার বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের মামলা এটাই। আমি নেপথ্যে থাকলেও মামলায় স্বাক্ষী হয়ে যান গোলাম আহাদ।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়াসহ দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক ধ্বস নামলে ও উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে ত্বরিৎ গতিতে মাহাথীর মোহাম্মদ ক্ষমতাচ্যুৎ করলে মালয়েশিয়ায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে থাকে। অন্যদিকে আমেরিকা ও ইউরোপ মালয়েশিয়ার উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করতে আগুনে ঘি ঢালতে থাকে। অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল IMF মালয়েশিয়াকে আর্থিক সাহায্য দিতে চাইলে মাহাথীর ঘৃনাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে জনগনকে বুঝান যে IMF বিনাস্বার্থে কাউকে টাকা দেয় না। মূলত এ নিয়েই উপ প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সচতুর মাহাথীরের দ্বন্ধের সূত্রপাত হয়। IMF যে তীরটা মাহাথীরকে মারতে চেয়েছিল সে তীর তাঁর কান ঘেঁষে প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশীয়ার প্রধানমন্ত্রী সুহার্তোর বুকে গিয়ে বাঁধে। সুহার্তো IMF এর ঋণ নিয়ে তাদের কথামত তেলের মূল্যবৃদ্ধি করলে জনবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সুহার্তোর ৩২ বছরের শাসনামলের পতন ঘটে। আর মালয়েশিয়ায় টাকার বিপরীতে রিঙ্গিতের বিনিময় হার ১২/১৩ টাকায় নেমে গেলে বিভিন্ন কোম্পানী দেউলিয়া হয়ে যায়। কাজ হারাতে থাকে শ্রমিকরা। দলে দলে শ্রমিক ফিরে যায় বাংলাদেশে। (আগামীকাল দেখুন)