নারায়ণগঞ্জ,বিজয় বার্তা ২৪
রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিজ জন্মস্থান চাষাঢ়া ছেড়ে স্ব-পরিবারে অন্যত্র বসবাসের ১৬ বছর পর পূনরায় উত্তর চাষাঢ়ায় বসবাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান।
মঙ্গলবার(২২ ফেব্রুয়ারী) সন্ধ্যায় উত্তর চাষাঢ়ায় অবস্থিত ওসমান পরিবারের বাসস্থান হীরামহল সংলগ্ন মাঠে এলাকাবাসীর সাথে মত বিনিময়কালে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি চাষাঢ়া এলাকার নিজের জন্ম থেকে শুরু করে শৈশব, কিশোর ও যৌবনের বিভিন্ন ঘটনার স্মৃতির কথা তুলে ধরেন। স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে সেলিম ওসমান নিজে কেদেঁছেন সাথে কেদেঁছেন সেই সকল স্মৃতির সাথে জড়িত মানুষ গুলো। বলেছেন নিজের ডানপিট্টের গল্প, বন্ধুদের সাথে নিয়ে গাছের গাছের ডাব, প্রতিবেশীদের মুরগি চুরি করে খাওয়ার গল্প। তুলে ধরেছেন মিসেস নাসরিন ওসমানের সাথে মন দেওয়া নেওয়ার কথা।
উত্তর চাষাঢ়া এলাকার মানুষের অনুরোধে সবার উদ্দেশ্যে কথা বলতে গিয়ে অজোড়ে কেঁদেছেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের সহ ধর্মিনী নাসরিন ওসমানও।
সেলিম ওসমানের মত স্বামী পেয়ে তিনি নিজেকে এখন সৌভাগ্যবান মানুষ দাবি করেই কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন আমার বাবা দাদার বাড়ি এখানে না হলেও আমি উত্তর চাষাঢ়াতেই জন্ম নিয়েছি। এখানে বড় হয়েছি। এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে আমার তিনটি সন্তান এখানেই জন্ম হয়েছে। এখানকার প্রতিটি মানুষের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক। আমি নিজেকে চাষাঢ়াবাসী হিসেবেই ভাবতে গর্ব বোধ করি। আমি অনেক কষ্টের পর অনেক আশা নিয়ে চাষাঢ়ায় নিজের বাড়ি করে ছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে মাত্র এক বছরের মধ্যেই আমাদের নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয়েছে। আমি আবারও চাষাঢ়াতেই এসে থাকতে চাই। আমি চাই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারনে যেন কাউকে তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে না হয়। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন সেলিম ওসমান আপনাদের সন্তান আমি আপনাদের সবার সাথে এই উত্তর চাষাঢ়াতে থাকতে চাই।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত-জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই চাষাঢ়া রামবাবুর পুকুরপাড় সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের বাড়ি গুলি বর্ষণ করা হয়েছি। সেই ঘটনার সময় নিজ জন্মস্থান চাষাঢ়া এলাকা ছেড়ে স্ব-পরিবারে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ২০০১ এরপর ২০১৬ পর্যন্ত সময়ে তার পরিবারকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছিল। নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, সেনাবাহিনীর নির্যাতন এমনকি অস্ত্র দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে বড় ভাই নাসিম ওসমানের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে এক সাথে দুই ভাই নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানের সংসদ সদস্য হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর তার শূন্য আসনে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন সেলিম ওসমান।
সেলিম ওসমান তার বক্তব্যে স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বলেন, আমি সংসদ সদস্য হিসেবে আপনাদের কাছে আসিনি। আমি আপনাদের সন্তান সেই ছোট বেলার সেল্লু হিসেবেই আপনাদের কাছে এসেছি। এই এলাকার আমি বন্ধুদের নিয়ে মানুষের নারিকেল গাছ থেকে ডাব চুরি, খোয়ারের মুরগি চুরি করে খাওয়া নিয়ে আমি খুব বিখ্যাত ছিলাম। একজন প্রেমিক হিসেবেও আমার বেশ পরিচিত ছিল। এই মহল্লারই একটি মেয়ে আমাকে বায়াস্ট করে দিয়েছিল। আমরা যতই দুষ্টামি করেছি একটা শাসন ছিল। কিন্তু ওই সময় আমাদের বাবা মা কিন্তু আমাদের শাসন করতেন না। আমাদের বাবা মায়েরা শুধু একটা জিনিসই দেখতেন মাগরিবের আগে বাসায় পৌছেছি কিনা। সারাদিন কোথায় ছিলাম। আমরা এলাকায় ঝগড়া করেছি রাস্তা নিয়ে ড্রেন নিয়ে। এখানেই একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। যেখানে বিচার আচার করা হতো। ঝগড়ার কথা কেউ আমরা মনে রাখতাম না। এলাকায় কোন সমস্যা হলে আমরা মুরুব্বি আর যুবকেরা মিলে মিশে সে গুলো সমাধান করতাম। আমার মায়ের মাধ্যমে একটি মার্দাস ক্লাব চলতো। সেখানে উত্তর চাষাঢ়ার মেয়েদের সেলাই প্রশিক্ষন, গান, নৃত্য সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষন দেওয়া হতো। সেখান থেকে অনেক মেয়েকেই আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে গিয়ে ছিলাম। এ সব কথা গুলো এখানকার ছেলে মেয়েরা বলতে পারবে না হয়তো তারা কখনও শুনেই নাই। আমরা টেনিস বল দিয়ে সাত চারা খেলতাম। ওই খেলায় আবার আমাদের পুরস্কারও দেওয়া হয়তো। হয়তো একটি খাতা, একটি কলম, রাবার পেন্সিল। আর এখনকার ছেলে মেয়েরা হয়তো দেখা যাবে এই সব খেলার নামই জানে না।
শববরাতের রাতে এক বাসা থেকে অন্য বাসায় হালুয়া রুটি দেওয়ার ভীড় লেগে যেত। এটা নিয়েও কয়েকদিন ভরে আলোচনা চলতো। আমি মটরসাইকেল চালিয়ে মহল্লা ঢুকে মানুষের বাড়ির সামনে গিয়ে জোরে জোরে নাক টানতাম। বাসায় কি রান্না হয়েছে গন্ধ নিতাম। পরে লোক পাঠিয়ে দিয়ে খাবার আনতাম। এই মহল্লায় ইলিয়াসের বউ আমাকে ভাই ডেকেছিল। সে ছিল আমার সব থেকে আদরের বোন। সে আমাকে বিভিন্ন সময় রান্না করে পাঠিয়ে দিতো। আমি মন চাইলেই কিছু না বলেই তার বাসায় গিয়ে উপস্থিত হতাম খাওয়ার জন্য। মাঝে মাঝে চিরকুট লিখে পাঠাতাম আজ রাতে ১৫/২০ আসবো। সে রান্না করে রাখতো আমরা গিয়ে খেয়ে আসতাম। এমন অনেক জালান তাকে জালাইতাম। এখন অনেক দিন তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নাই। তার মেয়ে শিউলি মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আর তার সামনা সামনি হই নাই।
এই সময় ইলিয়াসের স্ত্রী আলো এসে মঞ্চে উপস্থিত হয়ে সেলিম ওসমানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেন সাথে সেলিম ওসমানের দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠে। কান্না জড়িত কণ্ঠে সেলিম ওসমান তার সেই বোনটিকে প্রশ্ন করেন তুই আমাকে কি আর রান্না করে খাওয়াবি না? মিসেস ইলিয়াস কাদঁতে কাদঁতে উত্তর দেয় খাওয়াবো কবে আসবি ভাই। সেলিম ওসমান তখন প্রশ্ন করে কখনও বলে এসেছিলাম? মিসেস ইলিয়াস মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিলে সেলিম ওসমান বলেন না বলেই আসবো যে কোন দিন।
এ সময় একটি আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
মঞ্চে তার স্ত্রী নাসরিন ওসমানের কান্না দেখে সেলিম ওসমান বলেন, আমার পাশে দাড়ানো আমার সব থেকে ভালোবাসার মানুষটির কান্না দেখতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তার চোখে জল দেখতে পারি না। আপনারা মহল্লাবাসি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আবারও চাষাঢ়ায় বসবাস করতে চাই। আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি সপ্তাহের বৃস্পতিবার রাত থেকে শনিবার বিকেল পর্যন্ত আমি চাষাঢ়ার বাসায় স্ব-পরিবার নিয়ে থাকার চেষ্টা করবো। যদি প্রতি সপ্তাহে না পারি তাহলে অত্যন্ত মাসে একবারের জন্য হলেও আমি আপনাদের মাঝে থাকার চেষ্টার করবো যদি আপনারা অনুমতি দেন। এ সময় উপস্থিত সকলে সেলিম ওসমান চাষাঢ়ায় বসবাস করার ব্যাপারে জোর দাবি তুলেন।
আলোচনার এক পর্যায় সেলিম ওসামন সভায় উপস্থিত তরুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মঞ্চে তুলে এলাকার জন্য তাদের চাহিদার কথা জানতে চান। এ সময় তারা উত্তর চাষাঢ়া এলাকাটি ওয়াইফাই জোন, একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য একটি একাডেমিক ভবন, বিকেলে অবসর সময় ঘুরাফেরার জন্য একটি বসার স্থান, ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানান।
পরে সেলিম ওসমান উত্তর চাষাঢ়া এলাকাটি ফ্রি ওয়াইফাই, নারায়ণগঞ্জ কর্মাস কলেজে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষন কেন্দ্র এবং ছেলেদের ক্রিকেট খেলার সামগ্রী দ্রুত পূরণ করার কথা বলেন। সেই সাথে পুরনো সেই মাদ্রাস ক্লাবকে সচল, পরিত্যক্ত পুলিশ ফাড়ির জায়গা বিকেলে ঘুরাফেরা ও হাটাহাটির জন্য একটি বসার স্থান নির্মান করার কথা বলেন। পাশাপাশি দ্রুত পঞ্চায়েত কমিটি গঠন করে এলাকার মানুষের সাথে আলোচনায় বসে এলাকায় উন্নয়নে পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করার কথা বলেন। এছাড়াও তিনি এলাকার মসজিদ, এতিমখানা, স্কুল সহ প্রয়োজনীয় উন্নয়ন মূলক কাজ করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা বলেন।
আলোচনার পূর্বে সেলিম ওসমান চাষাঢ়া এলাকায় তার পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্রদের পাগড়ি পরিয়ে দেন।
অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম ভূইয়ার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন শামসুদোহা, মজিবুর রহমান সিনহা, আবুল হোসেন, শামসুল হক খান, খোকন মিয়া, শিরীন বেগম, আমজাদ হোসেন, সেন্টু মিয়া, ওসমান গনি, সাজু, মিজান প্রমুখ।