বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এক সময় স্রোতঃস্বিনী শীতলক্ষ্যায় স্বচ্ছ পানি, অসংখ্য নৌযান, গাঙচিল, মাছরাঙাসহ নানা পাখির ওড়াউড়ি ছিল, ছিল নানা রকমের মাছ। সেই শীতলক্ষ্যার পানি এখন কুচকুচে কালো, দুর্গন্ধময়। এ নদী এখন মৃত প্রায়। অথচ একটা সময় এ পানি গোসলসহ দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যবহার হতো। এমনকি মানুষ পানও করত। সেই শীতলক্ষ্যা ধ্বংসের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকেই দায়ী করছেন সচেতন মহল।
একসময় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে জাহাজে করে এই শীতলক্ষ্যা নদীর সুপ্রিয় পানি সরবরাহ করে নেওয়া হতো। নদীতীরের ডাইং কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ও শহরের বর্জ্য- মূলত এই দুই কারণে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পলিথিন ও নৌযানের বর্জ্য।
সম্প্রতি শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড় ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির অপরিশোধিত বর্জ্য নর্দমা ও খালের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে পড়ছে। শহরের ৫নং নৌঘাট থেকে শুরু করে ১নং ঘাট, লঞ্চঘাট হয়ে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত নদীর পাড় ধরে হেঁটে দেখা যায়, নদীর তীরে ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে। গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা সেখানে ফেলা হচ্ছে না। কোথাও কোথাও জমে আছে আবর্জনার স্তূপ।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নর্দমা ও খাল-বিল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি লিটার শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য এই শীতলক্ষ্যা নদীতে এসে মিলিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে হোটেল রেস্তোরাঁ, বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্যসহ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য।
বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে নানারকম শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। এসব শিল্প কারখানার অনেকই তরল বর্জ্য নির্গমণকারী। নিয়ম অনুযায়ী এসব কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) থাকার কথা। কিন্তু অনেক কারখানাতে তা নেই। এরমধ্যে ডাইং কারখানাগুলো অন্যতম। আবার যাদের ইটিপি আছে, পরিচালনা ব্যয় বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তা বন্ধ রাখছে বলে অভিযোগ।
শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের বাসিন্দা ইয়াছিন সাকিব বলেন, এক সময় নদীতে গোসল করতাম, মাছ ধরতাম। এখন আর গোসল করার মতো অবস্থা নেই, মাছ নেই। এখন কলকারখানার বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত ও নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মরে ভেসে উঠছে। এই পানি এখন আমাদের অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীকে দূষণের কবল থেকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।
বন্দর এলাকার এক বৃদ্ধ সুলতান মিয়া বলেন, আমাদের শৈশব কেটেছে এই নদীর পানিতে গোসল করে আর মাছ ধরে। এখন গোসল তো দূরের কথা, শরীরে পানি লাগলেই চুলকায়, চর্মরোগে আক্রান্ত হতে হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পানিতে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য ন্যূনতম ৪ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। কিন্তু শীতলক্ষ্যার পানিতে আছে মাত্র শূন্য দশমিক ১ মিলিগ্রাম। তবে বর্ষাকালে কিছুটা বেড়ে ২ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। ফলে এই নদীতে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকা দায়। পাশাপাশি গৃহস্থালি কাজেও শীতলক্ষ্যার পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি বলেন, শীতলক্ষ্যার তীরে গার্মেন্টস, ডাইং ও সিমেন্ট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিশোধন ছাড়াই তরল রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে ছাড়পত্র নেয়, প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালনা করছে? এখানে অর্থনৈতিক লেনদেন রয়েছে। এর সঙ্গে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন জড়িত বলে মনে করি। যদি তা না হতো তাহলে দুর্বৃত্তরা এভাবে একটা নদী ধ্বংস করতে পারে না। এসব কারণেই নদীদূষণ রোধ করা যাচ্ছে না।
দূষণ রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় আনতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো ধরনের বিচার বিবেচনা ছাড়াই ছাড়পত্র দিচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে। সরকার কঠোর হলেই নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নগর পরিকল্পনাবিদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের পয়োবর্জ্য নদীতে পরিশোধন করে ফেলার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্লাস্টার ইটিপি বসানো হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে শীতলক্ষ্যা নদীর অবস্থার উন্নতি হবে, দূষণ কমবে। এ ছাড়া নদীর দখল-দূষণ কমাতে আরও কিছু প্রকল্প চলমান আছে। সেগুলো বাস্তবায়ন হলে নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শেখ মুজাহীদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৫০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আছে, যারা রাসায়নিক তরল বর্জ্য নির্গমণ করে। এগুলোর মধ্যে ৩৫৭টি প্রতিষ্ঠানে ইটিপি রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই সরাসরি নর্দমা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলছে।
নদীদূষণ বন্ধে প্রতি মাসেই অভিযান পরিচালনা করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব কারখানায় ইটিপি নেই সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যারা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে কারখানা সিলগালা করা হচ্ছে। সর্বোপরি নদীদূষণ বন্ধে কাজ করছি।