বিজয় বার্তা ২৪ ডট কম
শঙ্কা-ই সত্যিই হলো। সমাপ্ত হলো টেনিস সার্কিটে একটা যুগের। অবসরের ঘোষণা দিলেন রজার ‘রাজা’ ফেডেরার। চোট-আঘাত থামিয়ে দিলো উইম্বলডন সম্রাটকে। টুইট বার্তায় জানিয়ে দিলেন, রজার ফেডেরার এখন ইতিহাস। যার র্যাকেটে সৃষ্টি হয়েছে অনেক ইতিহাস।
টেনিস দুনিয়ার কোটি ভক্তের হৃদয় ভেঙে দিয়ে অবসরের ঘোষণা দিলেন একচল্লিশেও চির সবুজ ফেডেরার। তার সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের হৃদয়ের কর্ডে বেজে চলেছে করুণ এক সুর। সেই সুরে একটা বাক্য বসিয়ে দেয়া যায় অনায়াসে, ‘রাজার অনুপস্থিতিতে গরীব হয়ে গেলো টেনিস।’
রাফায়েল নাদাল, জকোভিজ যাদের গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যা ফেদেরারের চেয়ে বেশি। তারা আছেন। তবুও আর্তি, ফিরে আসুন রজার। কিন্তু তিনি আর ফিরবেন না। উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টের সবুজ ঘাসও আপনার অভাবে ঔজ্জ্বল্য হারাবে। রাফায়েল নাদালের যেমন আছে ফ্রেঞ্চ ওপেনের দুর্গ, তেমনি আপনার উইম্বলডন। পিট সাম্প্রাসের মত কিংবদন্তির জয়রথকে থামিয়ে অল ইংল্যান্ড ক্লাবেই আপনার রাজকীয় উত্থান হয়েছিল। তারপর থেকে সেখানেই আপনার সাম্রাজ্য। আট আট বার উইম্বলডনের ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন। সেখানকার সবুজ মখমলে র্যাকেট হাতে আপনি সম্মোহিত করে রেখেছেন ভক্তদের। স্যাটেলাইটে যা প্রক্ষেপিত হয়েছে গোটা দুনিয়ায়। আবার সেই উম্বলডন থেকেই হারের ধাক্কায় রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন, ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কোর্ট ছেড়েছিলেন। তারপর আপনার গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যাটা আর বিশ থেকে বাড়িয়ে নেওয়া হলো না! রাফা-জকোরা আপনাকে ছাড়িয়ে গেলেন।
বয়স হয়েছে। ট্রফি জেতা বন্ধ হয়েছে। মন টানলেও শরীর চলেনি। কিন্তু আপনার র্যাকেটে মরিচা ধরেনি। চতুর্থবার হাঁটুর অস্ত্রোপচার হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘পরেরবার মানে, ২০২৩-এ উইম্বলডন খেলতে পারলে সেটা হবে বড় অঘটন।’ না, সেই অঘটন আপনি আর ঘটাতে পারলেন না! শঙ্কাটাই সত্যি হলো। আপনার আর ফেরা হলো না।
আপনি না থাকলেও টেনিস দুনিয়ায় অনেক মহাতারকা আছেন। আগামীতে আরও অনেকের আগমন ঘটবে। কিন্তু আপনার মত জিনিয়াস থাকছেন কোথায়! আপনার বন্ধু যোদ্ধা রাফা। মেশিন জকোভিজ। তারাও আপনার বিদায়ে শোকাহত। শুধু টেনিস সার্কিট নয়, আপনার অবসরের করুণ সুর বাজছে ক্রীড়া বিশ্বে। শচীন টেন্ডুলকার টুইট করেছেন— ‘রজার আপনি কি শুধু টেনিস খেলেছেন! আপনি অবসরে যেতে পারেন। আপনার টেনিস অবসরে যায় কীভাবে।’ সত্যিই তো আপনার ফোরহ্যান্ড ভুলবে কীভাবে? ওটা টেনিস ভক্তদের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
আপনি নীরবে, নিঃশব্দে বিদায় দিলেন! জিনিয়াসরা কি এমনই হয়? ভক্তদের বিদায়ী আবেগে ভাসতে দিলেন না আপনি। ভাসতে দিলো না আপনার হাঁটু! খেলার জগতের সর্বকালের এক সেরা তারকার এমন বিদায় বেমানান। কি গতিতে টেনিসের একের পর এক শৃঙ্গে আরোহণ করেছেন আপনি। কখনও আবার মাটিতে পড়ে গেছেন। কিন্তু দৃঢ় সংকল্পে খাদের কিনার থেকে ফিরে এসেছেন। গ্র্যান্ড স্লাম জয় থেমে গেলেও টেনিসের প্রতি ভালবাসা কমেনি আপনার। কারণ, রাজত্ব পুনরুদ্ধারের সংকল্প ছিল আপনার। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? কোর্টে নয়, আপনাকে আত্মসমর্পণ করতে হলো অপারেশন থিয়েটারে! মানসিক যুদ্ধটা থেমে গেলো সেখানে।
রজার আপনার লড়াই, ভদ্রতা আর ট্রফি জয়ের ইতিহাস বলে, আপনার জন্য শোকগাঁথা অন্যরা লিখতে পারেন না। ২০১২ তে ব্রিটিশদের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে অ্যান্ডি মারেকে হারিয়ে সপ্তমবার উইম্বলডন জিতেছিলেন। ফ্ল্যাশব্যাকে চোখের সামনে চলে আসে মারের কান্না আর আপনার সেই ভুবন ভোলানো হাসি! ওটা ছিল আপনার ১৭তম গ্র্যান্ড স্লাম জয়। তারপর আবার ট্রফিহীন। পাঁচ বছর পর আবার ট্রফি উঁচিয়ে ধরলেন। তারপর মানুষ বলতে শুরু করেন, রজার শেষ! কেন কোর্টে পড়ে আছেন! আর তো ট্রফি জিতবেন না! আপনি ফিরলেন। আপনার মত করে ফিরলেন। চলমান পদ্য হয়ে ফিরলেন। ৩৫ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন। তারপর উইম্বলডন। এরপর আবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। গ্র্যান্ড স্লামের সংখ্যা বেড়ে হলো বিশ। টেনিস দুনিয়ায় আবার সেই জয়ধ্বনি— রজার, রজার, রজার!
আপনার বিদায়েও সেই শব্দটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে টেনিস সার্কিটে। রজার, রজার, রজার! সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার কোনো মনোরম পরিবেশে আপনার খুব কাছের লোকেরা ছাড়া হয়তো কেউ দেখতে পাবেন না, বহুযুদ্ধে জয়ী যোদ্ধার যন্ত্রণাকাতর মুখটা। যিনি ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাঁটুর কার্টিলেজের কাছে হার মানলেন।
টেনিস কোর্টে আপনি হার মানলেন। কিন্তু মানুষের হৃদয়ের কোর্টে রজার ফেডেরার আপনি টেনিসের অবিসংবাদী সম্রাট। টেনিস সার্কিটে একটা কথা চালু আছে—হয় তুমি গ্রাস কোর্ট বিশেষজ্ঞ, নয় তো ক্লে কোর্ট বিশেষজ্ঞ। আর নয় তো তুমি রজার ফেডেরার।
শচীন টেন্ডুলকার ঠিক বলেছেন, টেনিস থাকবে। আপনি থাকবেন। আপনি অবসরে যান কীভাবে! আপনার টেনিস স্মৃতির অভিজাত এক আলাদা সরণিতেই থাকবে রজার। মানুষের হৃদয় জিতে রজার আপনি সত্যিই ’রাজা’।
লেখক:অঘোর মন্ডল- সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট